আইএস একটি মহামারির নাম | উনবিংশ পর্ব

✍🏻 আবু হাজার আল কুর্দি

এই চরম উত্থান-পতনে পূর্ণ ঘটনাপ্রবাহের ধারায় এবার আমরা আলোচনায় আনবো ইরাকের ভুখণ্ডে দাঈশ-সৃষ্ট প্রতারণার দীর্ঘ ছায়া এবং সে সকল নিষ্ঠুর নির্যাতনের বর্ণনা, যা তারা ‘আর-রাফিদাইন’-এর মাটিতে আহলে সুন্নাতের বিরুদ্ধে সংঘটিত করেছে।

ইরাকে দাঈশের বিশ্বাসঘাতকতা কেবল ধারণাতীতই ছিল না, বরং তা ছিল এমন বেদনাদায়ক—যা কল্পনাকেও পিছনে ফেলে দেয়। ইরাকি জাতির জন্য এই অধ্যায় ছিল এক অনির্বচনীয় ট্র্যাজেডি; তবে আরও গভীর ক্ষতির শিকার হন আহলে সুন্নাতের সেই বীর মুজাহিদগণ এবং প্রতিরোধের সেই সমস্ত তাওহিদপন্থী জামা‘আতসমূহ, যারা আগেই দখলদার শক্তি, স্বৈরশাসক ও বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে আত্মোৎসর্গমূলক জিহাদে লিপ্ত ছিলেন।

দাঈশ মিথ্যা খিলাফাহর জিগির তুলে শুধু ইসলামের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করেনি, বরং তারা সুন্নি ও জিহাদি আন্দোলনের গভীরতম শিকড়ে আঘাত হানে। এ বিভীষিকাময় অধ্যায়ের কয়েকটি কেন্দ্রীয় উপাখ্যান তুলে ধরা হলো—
১. আহলে সুন্নাত মুজাহিদদের ঐক্যচ্যুতি ও বিশ্বাসঘাতকতা
দাঈশের আবির্ভাবের পূর্বে ইরাকে আহলে সুন্নাতের বহু সম্মানিত জামা‘আত—যেমন: জায়শুল মুজাহিদীন, আনসারুল ইসলাম, জায়শুন নকশবন্দিয়া প্রভৃতি—দখলদারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু দাঈশ এ সকল গোষ্ঠীকে ‘কাফির’ ও ‘মুরতাদ’ আখ্যা দিয়ে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়; অনেককে হত্যা করে, আবার অনেককে দেশান্তরে বাধ্য করে।

এ নির্মম ও আত্মঘাতী মনোভাব শুধু দুশমনদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সুন্নি ঐক্যকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়নি, বরং ভিতর থেকেই প্রতিরোধ আন্দোলনকে দুর্বল ও বিপর্যস্ত করে তোলে।

২. আহলে সুন্নাত নিধনে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর হাতে অজুহাত তুলে দেওয়া
দাঈশ এমন সব দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়—যেমন জনসমক্ষে শিরোচ্ছেদ, মসজিদ ও মাজার ধ্বংস, সংখ্যালঘুদের উপর অমানবিক নির্যাতন—যা শুধু ইসলামের সৌন্দর্য ও সমতার বাণীকে বিকৃত করে তোলেনি, বরং পুরো বিশ্বব্যবস্থার কাছে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ নামক এক ভ্রান্ত ও ধ্বংসাত্মক অভিযানকে নৈতিক ভিত্তি দান করে।

ফলস্বরূপ, আহলে সুন্নাত অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে নির্বিচারে বোমাবর্ষণ এবং অস্ত্রবাহিনী পাঠানোর পথ প্রশস্ত হয়, যেখানে নিরপরাধ সাধারণ মানুষই হয় প্রথম শিকার।

৩. সুন্নি ভূখণ্ডে দখল প্রতিষ্ঠা ও জনতার উপর শোষণমূলক শাসন চাপিয়ে দেওয়া
মসুল, ফালুজাহ, রামাদি ও তিকরিত—এইসব শহর দাঈশের কবলে গেলে অনেকেই ভেবেছিল যে হয়তো সুন্নি জনতার স্বস্তি ও স্বাধীনতার সূচনা ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে তারা এমন এক স্বৈরাচার ও বিভীষিকাময় শাসন কায়েম করে, যার সঙ্গে ইসলামের কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর।

সেইসব আলেম, গোত্রনেতা ও সাধারন মানুষ—যারা দাঈশের এই বেদনা-নির্ভর ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন—তাদের হত্যা করা হয়, অথবা নির্যাতনের বিভীষিকাময় জগতে ঠেলে দেওয়া হয়।

৪. জিহাদের পবিত্র রূপ ও ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করা
দাঈশ এমন এক জাহান্নামি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, যার ফলে জিহাদ, খিলাফাহ, এবং ‘আমর বিল মা‘রূফ ও নাহী আনিল মুনকার’-এর মতো মহিমান্বিত শরঈ প্রজ্ঞাকে রক্তাক্ত স্লোগানে রূপান্তরিত করা হয়। তাদের হাত ধরে জিহাদ আর আত্মত্যাগের পবিত্রতা হারিয়ে ফেলে বিশ্বাসযোগ্যতা, মানুষ ইসলামি পরিভাষার প্রতি ভীত ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

ফলে, ইসলামী মূল্যবোধের পরিচয় মুছে গিয়ে তার স্থানে কেবল হিংসা, বর্বরতা ও দুঃশাসনের প্রতিচ্ছবি প্রতিস্থাপিত হয়।

৫. ইরান ও পশ্চিমা শক্তির প্রভাব-প্রবেশের জন্য মসৃণ পথ তৈরী করা
যদিও দাঈশ মুখে ইরানের বিরোধিতা করেছিল, বাস্তবে তাদের কর্মকাণ্ড ছিল ইরানকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ারই পূর্বসোপান। দাঈশের ভয়ে বহু সুন্নি এলাকা ইরান-ঘনিষ্ঠ মিলিশিয়াদের দখলে চলে যায়। একইভাবে, দাঈশ নির্মূলের অজুহাতে আমেরিকা-নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোট সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, যা বহিরাগত বাহিনীর প্রত্যাবর্তনের জন্য এক আন্তর্জাতিক বৈধতা তৈরি করে দেয়।

Exit mobile version