আইএস একটি মহামারির নাম | বিংশ পর্ব

✍🏻 আবু হাজার আল কুর্দি

দাঈশি খারিজিদের অপরাধের সীমা–পরিসীমা নেই; পৃথিবীর প্রতিটি কোণে তাদের নিষ্ঠুরতার দৃষ্টান্ত ও অভিঘাত অনুপুঙ্খে দৃশ্যমান। নিরপরাধ মানবতার ভাগ্যাকাশে তাদের নিপীড়নের কালো ছায়া ঘনীভূত হয়ে রয়েছে।

যখন দাঈশ শামের বক্ষে লক্ষাধিক নিরপরাধ প্রাণ নির্মমভাবে নিধন করল, তারা ইরাকেও অশুচি পদচিহ্ন রাখল এবং একই সঙ্গেই দুই নদীর ভূভাগ—রাফিদাইনের দেশগুলো নিওড় করে তাদের অরাজক জবরদখল অব্যাহত রাখল।

২০১৪ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে বাগদাদি খারিজিরা, যারা তখন “ইসলামী রাষ্ট্র ইরাক” নামে পরিচিত ছিল, মার্কিন ও ইরাকি বাহিনীর সঙ্গে, বিশেষত আনবার প্রদেশে দীর্ঘস্থায়ী সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে কিয়দ্দূর সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল।

কিন্তু ২০১১ খ্রিস্টাব্দে শামে গৃহযুদ্ধের উদ্ভব তাদের পুনর্গঠিত ও বিস্তার লাভের সুবর্ণ অবকাশ এনে দেয়। দাঈশের উত্থানের পেছনে কোনো গণ–সমর্থন ছিল না; বরং ছিল নিছক শক্তির প্রদর্শন, দমন ও ভয়ের ছায়াতলে মানুষকে বশ্য বানানোর নির্মম কৌশল।

মসুল দখল এবং একে হত্যাযজ্ঞ–বেদঘাতের অক্ষে পরিণত করা

১০ জুন ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে দাঈশ সুচারু নকশা মাফিক, সর্বাত্মক ঝটিকা আক্রমণের মাধ্যমে ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর মসুল দখল করে। দুই মিলিয়নেরও অধিক জনসমষ্টির এ মহানগরটি ছিল নাইনাওয়া প্রদেশের প্রাণকেন্দ্র।

আক্রমণের সারসংক্ষেপ

আক্রমণ উপকণ্ঠ থেকে শুরু হয়ে অতি দ্রুতে নগরাভ্যন্তরে সদম্ভে ছড়িয়ে পড়ে। দাঈশি বাহিনীর শক্তিমত্তা আনুমানিক আট শত থেকে এক সহস্র যোদ্ধায় সীমিত ছিল।
ইরাকি সেনাদের হাতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও সাঁজোয়া সরঞ্জাম সত্ত্বেও যুদ্ধেচ্ছা ছিল শীতল; অধিকাংশ সৈনিক কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই নগর ত্যাগ করে।
ফলে ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যানসহ বিপুল আধুনিক যুদ্ধ–উপকরণ দাঈশের করায়ত্তে চলে যায়।

মসুল পতনের তাৎপর্য

১. সামরিক মাত্রা
মসুল দখল করে দাঈশ বিপুল অস্ত্রভাণ্ডার ও অর্থনৈতিক সম্পদ লুট করে। নগরীর কেন্দ্রীয় ব্যাংক লুটে তারা বিপজ্জনক অর্থশক্তি সঞ্চয় করে, যার জোরেই আরও ভূখণ্ডে তাদের অগ্রযাত্রা তরান্বিত হয়।

২. রাজনৈতিক মাত্রা
এ পতন নূরী আল-মালিকি সরকারের অন্তর্গত দুর্বলতাকে নগ্ন করে দেয়। ফলে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপ তীব্র হয়, যাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পিরামিডে রদবদলের আবশ্যকতা সামনে আসে।

৩. প্রচারণা-মাধ্যমিক মাত্রা
২৯ জুন ২০১৪-তে দাঈশ মসুলের জামে আন-নূরী মসজিদে কথিত ‘ইসলামী খেলাফত’ ঘোষণা করে; এখানেই আবুবকর আলবাগদাদি প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে আবির্ভুত হয়।

৪. নিরাপত্তা ও মানবিক মাত্রা
নগর দখলের পর ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়। ইয়াজিদি, খ্রিস্টান ও শিয়া-সহ নানা ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা প্রাণক্ষয়, বাধ্যতামূলক পলায়ন, অথবা জোরপূর্বক উৎখাতের মুখোমুখি হয়।

মসুল পতনের পরবর্তী প্রেক্ষিত

মসুল দখলের পর পরই দাঈশ দ্রুত নাইনাওয়া, সালাহউদ্দিন, দিয়ালা ও আনবার প্রদেশেও আধিপত্য স্থাপন করে। তিকরিত, ফালুজা ও রামাদিসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ নগর স্বল্প কালের মধ্যে তাদের অধীনে চলে আসে। স্বর্ণযুগে তারা ইরাকের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভূভাগ কব্জা করেছিল।

মসুল যুদ্ধের অবসান

জুলাই ২০১৭-তে, নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শেষে, যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোটের সহায়তায় ইরাকি বাহিনী অবশেষে মসুলকে দাঈশের কবলমুক্ত করে। এ যুদ্ধ ভয়াবহ মানবিক ক্ষয়-ক্ষতি ও স্থাপত্য-ধ্বংসের সাক্ষ্য বহন করে।

নোট

মসুল যুদ্ধের অপ্রকাশিত দিক ও গোপন নথিপত্র, ইন শা আল্লাহ, এই ধারাবাহিকের পরবর্তী পর্বে পরিবেশিত হবে।

Exit mobile version