​আবু উবাইদাহ (আল্লাহ তাঁর শাহাদাত কবুল করুন); মুসলিম উম্মাহর প্রকৃত সন্তান!

✍🏻 ​আবদুল বাসির উমারি

যখন মাদিনা মুনাউওয়ারায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে নববী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো, সেদিন থেকেই এই রাষ্ট্রের অধীনে সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে বিভিন্ন দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়েছিল। যেহেতু পরিস্থিতি ছিল যুদ্ধবিগ্রহ ও সামরিক উত্তেজনার এবং নববী রাষ্ট্র বিশ্বের কুফরি ও ত্বাগূতি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, তাই অধিকাংশ দায়িত্বই ছিল সামরিক ও জিহাদ সংশ্লিষ্ট। অনেক সাহাবীকে সারিয়াহর (ছোট যুদ্ধাভিযান) নেতৃত্ব, পতাকাবাহী হওয়া এবং লস্করের ডান ও বাম প্রান্তের কমান্ডারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

​সেই যুগে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য দায়িত্ব ছিল কবিতা, যা বর্তমান সময়ের ‘মুখপাত্র’ বা ‘গণমাধ্যম মুখপাত্রের’ ভূমিকার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। নববী রাষ্ট্রের যুদ্ধ ও সামরিক কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা দেওয়া, বিজয়সমূহকে ফুটিয়ে তোলা, মুশরিক ও কাফেরদের দুর্বলতা প্রকাশ করা এবং তাদের হীন কর্মকাণ্ড উন্মোচন করা—এই সব কাজ কাব্যিক ভাষায় পালন করতেন হযরত হাসসান বিন সাবিত (রা.)।

​রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের খবর প্রচারের সময় হযরত হাসসান বিন সাবিত (রা.)-কে উৎসাহিত করতেন এবং তাঁর জন্য এই দুআ করতেন: “হে আল্লাহ! রুহুল কুদ্দুসের (জিবরাইল আ.) মাধ্যমে তাঁকে সাহায্য করুন।”
অন্য এক সুযোগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেছিলেন: “তাদের দোষ-ত্রুটি (কবিতার মাধ্যমে) বর্ণনা করো, জিবরাইল (আ.) তোমার সাথে আছেন।”

সুতরাং মুসলিমদের বিজয় প্রচার করা, কাফেরদের যুলুম প্রকাশ করা এবং ইসলামি সাফল্য জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া নববী রাষ্ট্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবে গণ্য হতো এবং এর জন্য বড় সওয়াব ও মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে।

​বর্তমান যুগে ইসলামের কঠোর ও নির্মম শত্রুদের সাথে প্রথম কিবলার মর্যাদা এবং আম্বিয়ায়ে কেরামের পবিত্র ভূমির জন্য গত প্রায় সত্তর বছর ধরে এক তীব্র ও চূড়ান্ত লড়াই চলছে। এই বরকতময় যুদ্ধে হামাসের সামরিক শাখা ‘কাতায়েব আল-কাসসাম’ এক অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে; তারা হাজার হাজার ইয়াহুদিকে তাদের পরিণতির দিকে পাঠিয়েছে, গগনচুম্বী দালানকোঠাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে এবং মসজিদে আকসার পবিত্র প্রাঙ্গণ থেকে শত্রুদের শান্তি কেড়ে নিয়েছে। একইভাবে তারা হাজার হাজার আত্মোৎসর্গকারী মুজাহিদকে কুরবানির ময়দানে পেশ করেছে এবং তাঁদের ডজনখানেক নেতা শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেছেন।

​এই মহান নেতাদের মধ্যে উম্মাহর এক প্রকৃত সন্তান এবং ইসলামের সাহসী সিপাহসালার ছিলেন কমান্ডার হুযাইফা আল-কাহলুত (আবু উবাইদাহ)। আবু উবাইদাহ ছিলেন ইসলামের সেই বীরদের একজন, যিনি তাঁর সংকল্পবদ্ধ ও গম্ভীর কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে হযরত হাসসান বিন সাবিত (রা.)-এর মিশনের মতো দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি তাঁর পুরো জীবন জিহাদের মহান দায়িত্ব পালনে অতিবাহিত করেছেন।

​যখনই তিনি ‘আল-জাজিরা’র পর্দায় আবির্ভূত হতেন, সাথে নিয়ে আসতেন চূড়ান্ত বার্তা; চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতেন ইসরায়েলি সৈন্যদের প্রতি। তাঁর কণ্ঠনালি থেকে বেরিয়ে আসা সেই বজ্রকণ্ঠ ইয়াহুদিদের অন্তরে কাঁপন ধরিয়ে দিত। এই কারণেই পুরো আরব বিশ্বে তিনি এক অত্যন্ত প্রভাবশালী ও মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

​আবু উবাইদাহর আসল নাম হুযাইফা সামির আবদুল্লাহ আল-কাহলুত। তিনি ১৯৮৫ সালে গাযযা উপত্যকায় জন্মগ্রহণ করেন। গাযযার অন্যান্য বাসিন্দাদের মতো তিনিও শৈশব থেকেই ইসরায়েলি শত্রুতার ছায়ায় বেড়ে উঠেছেন। ২০০৪ সালে তাঁকে কাসসাম ব্রিগেডের মুখপাত্র নিযুক্ত করা হয় এবং তখন থেকেই তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত মিডিয়া লড়াই শুরু করেন। তাঁকে কাসসামের মিডিয়া কার্যক্রমের মূল মুখ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রবিন্দু মনে করা হতো।

​আবু উবাইদাহ প্রথমবার মিডিয়াতে আলোচনায় আসেন যখন তিনি ইসরায়েলি সৈন্য গিলাদ শালিতকে বন্দি করার ঘোষণা দেন। তাঁকে সবসময় সামরিক পোশাকে দেখা যেত; মাথায় লাল কুফিয়া, মুখে মাস্ক যাতে কালিমা তাইয়্যেবা এবং তার নিচে ‘কাতায়েব আল-কাসসাম’ লেখা থাকত। কুফিয়ার মাঝখানে থাকত কাসসাম ব্রিগেডের সরকারি প্রতীক।

​৭ অক্টোবর ২০২৩-এ আবু উবাইদাহ ‘তুফান আল-আকসা’ অভিযানের ঘোষণা দেন, ইয়াহুদি বাহিনীকে প্রকাশ্য সতর্কবার্তা দেন এবং মুসলিম বিশ্বের কাছে মসজিদে আকসা রক্ষার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। অবশেষে হামাস ইসলামি আন্দোলন ২৯ ডিসেম্বর আবু উবাইদাহর শাহাদাতের ঘোষণা দেয় এবং তাঁর স্থলে নতুন মুখপাত্র নিয়োগের খবর জানায়।

আবু উবাইদাহ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সেই বিখ্যাত কিছু বক্তব্য (মূল্যবান মুক্তো), যা মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক খ্যাতি পেয়েছে:
​১. “আমাদের লড়াই আমাদের জনগণের অধিকারের জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে, যতক্ষণ না দখলদারিত্ব শেষ হয়, অবরোধ তুলে নেওয়া হয় এবং বাস্তুচ্যুত মানুষ নিজ ঘরে ফিরে আসে।”
​২. “শত্রুরা যুদ্ধক্ষেত্রে যা অর্জন করতে পারেনি, হুমকি আর প্রতারণার মাধ্যমেও তা অর্জন করতে পারবে না।”
​৩. “শত্রুকে জানাযা আর লাশের মুখোমুখি হতে হবে, যতক্ষণ না দখলদারিত্বের বর্বরতা ও যুদ্ধের অবসান ঘটে।”
​৪. “আমাদের মুজাহিদরা স্বাধীনতার পথে অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এবং শত্রুর বিরুদ্ধে সফল হামলাগুলো ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।”
​৫. “তুফান আল-আকসা যুদ্ধ এই অঞ্চলে নতুন ভারসাম্য তৈরি করেছে এবং শত্রুকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, তারা ততটা শক্তিশালী নয় যতটা তারা দাবি করে।”
​৬. “ইসলামি ও আরব বিশ্বের নেতা, বুদ্ধিজীবী এবং আলেমদের ওপর লক্ষ লক্ষ নির্দোষ মানুষের রক্তের দায় বর্তাবে, কারণ তাঁরা এই মানুষগুলোকে শত্রুর মোকাবিলায় একা ছেড়ে দিয়েছিলেন।”

Exit mobile version