ইসলামি ইমারাতের বিরুদ্ধে দাঈশি খারিজিদের প্রোপাগাণ্ডা ও আপত্তিসমূহের শরঈ বিশ্লেষণ | ষষ্ঠ পর্ব

✍🏻 মৌলভী আহমাদ আলী

এই সিরিজের প্রথম অংশে আমরা উল্লেখ করেছি যে, দাঈশি খারিজিরা সম্প্রতি ভয়েস অব খোরাসান ম্যাগাজিনের উনচল্লিশতম সংখ্যায় ইসলামী ইমারাত, আমেরিকা ও ইসরাইলের মধ্যে গোপন যোগাযোগের দাবি তুলেছে।

আমাদের জ্ঞানে ইসলামী ইমারাত ও ইসরাইলের মধ্যে এমন কোনো গোপন সম্পর্কের বাস্তবতা নেই। যদিও শরীয়তের আলোকে কোনো কাফিরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা সর্বাংশে নিষিদ্ধ নয়। যেমন, বিভিন্ন সময়ে ইসলামী ইমারাতের নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহে আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা করেছে।

দোহা চুক্তির সফলতা অর্জনের আগে ও পরে এ আলোচনা ও যোগাযোগ গোপন রাখা হয়নি; বরং প্রকাশ্যেই সম্পাদিত হয়েছে এবং সমগ্র বিশ্ব তার সাক্ষী। আলহামদুলিল্লাহ, এসব প্রচেষ্টা সবই শরীয়তের সীমানার ভেতরে থেকে পরিচালিত হয়েছে।

এভাবেই বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গেও সময়ে সময়ে ইসলামী ইমারাতের নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানসমূহ বৈঠক করে থাকে। আফগানিস্তান এমন এক দেশ, যেখানে লাখো মুসলিম বাস করে। তাদের সচ্ছল ও স্থিতিশীল জীবনযাপন এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড সুসংগঠিত রাখার জন্য বিশ্বসমাজের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন অপরিহার্য। তবে আলহামদুলিল্লাহ, ইসলামী ইমারাতের অভ্যন্তরীণ কিংবা বৈদেশিক—সব নীতিই সর্বদা শরীয়তের সীমারেখার ভেতরেই প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।

কাফিরদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন পুরোপুরি নিষিদ্ধও নয়, আবার সম্পূর্ণভাবে বৈধ ও সঠিকও নয়; বরং এ ব্যাপারে বিস্তারিত বিধান রয়েছে। কখনো এ ধরনের সম্পর্ক কুফরের পর্যায়ে পৌঁছে যায়, কখনো তা বৈধ ও সঠিক হয়, আর কখনো কুফর ও অকুফরের মাঝামাঝি অবস্থায় মতভেদ দেখা দেয়। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ইমাম ও প্রাচীন বরেণ্য ব্যক্তিত্বরা এসব বিভাগ সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

কাফিরদের সঙ্গে আকীদাগত সম্পর্ক রাখা বা অন্তরের ভালোবাসা লালন করা নিঃসন্দেহে কুফর। কিন্তু শরীয়তের সীমারেখার মধ্যে তাদের সঙ্গে চুক্তি-সমঝোতার সম্পর্ক গড়া, মানবিকতার ভিত্তিতে প্রতিবেশীর মতো সহাবস্থান করা, কিংবা আত্মীয়তার সূত্রে সম্পর্ক বজায় রাখা শরীয়ত সম্মতভাবে নিষিদ্ধ নয়।

তবে পার্থিব স্বার্থ ও উদ্দেশ্যে কাফিরদের সঙ্গে মিলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহযোগিতা করার বিষয়ে মতভেদ পাওয়া যায়। এ ধরনের সম্পর্ক, সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে আমরা পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করব।

কারণ, বর্তমান যুগে দাঈশি খারিজিরা মিথ্যা কিংবা ভিত্তিহীন গুজবের ওপর ভর করে মুসলিমদের কাফির বলে রায় দেয়। কখনো কারও বিরুদ্ধে দাবি তোলে যে, সে নাকি মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করছে, এবং পরিণামে তার ওপর কুফর ও রিদ্দার (ধর্মত্যাগের) ফাতাওয়া জারি করে। অথচ সালাফদের মধ্যে কেউই মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতাকে সর্বাংশে কুফর হিসেবে অভিহিত করেননি।

হ্যাঁ, যদি এ সহযোগিতার ভেতরে আকীদাগত বিভ্রান্তি থাকে, তবে তা কুফর ও রিদ্দাতে রূপ নেবে। কিন্তু যদি আকীদা সঠিক থাকে এবং কেবল পার্থিব স্বার্থের জন্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করা হয়, তবে তা নিঃসন্দেহে এক মহাপাপ, অপরাধ ও বিশ্বাসঘাতকতা বটে; কিন্তু সালাফ তথা সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, ইমামগণ এবং আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের পরবর্তী বরেণ্য আলিমদের সর্বসম্মত দৃষ্টিতে এটি কুফর বা রিদ্দাত নয়।

যদিও কিছু পরবর্তী আলিমের সংক্ষিপ্ত উক্তিতে তাকফিরের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কিন্তু সালাফদের সর্বজনীন অবস্থান এবং অধিকাংশ পরবর্তী আলিমদের মতামতের সামনে এসব অস্পষ্ট উক্তির কোনো বিশেষ মূল্য নেই। বরং সেগুলো কেবল কঠোরতা ও ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে।

আধুনিক যুগের কিছু আলিমের বক্তব্যে তাকফিরের মত পাওয়া যায়; তবে সালাফদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান এবং পরবর্তী অধিকাংশ আলিমের মতামতের বিপরীতে তাকফিরের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে সমকালীন আলিমদের বক্তব্যকে প্রাধান্য দেওয়া মোটেই সঙ্গত ও যুক্তিসঙ্গত নয়।

এই প্রবন্ধের পরবর্তী অংশগুলোতে আমরা এ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করব। এ ধরনের সহযোগিতাকেই “মুযাহারাতুন ‘আলাল মুসলিমীন” বলা হয়।

 

Exit mobile version