ইসলামি ইমারাতের বিরুদ্ধে দাঈশি খারিজিদের প্রোপাগাণ্ডা ও আপত্তিসমূহের শরঈ বিশ্লেষণ | সপ্তম পর্ব

✍🏻 মৌলভী আহমাদ আলী

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আবদুল ওহহাব আন-নাজদী রহিমাহুল্লাহর অনুসারী ও অনুগামীরা “আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা” (আনুগত্য ও বিমুক্তি) শিরোনামে এই প্রসঙ্গে ব্যাপক মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। তারা আরব মুসলিমদের, যারা আল-সাউদের বিরুদ্ধে শেষ ইসলামী খিলাফত উসমানী খিলাফতের সেনাবাহিনীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, “আল-মুয়ালাত” (কাফেরদের সঙ্গে জোট) এর অজুহাতে মুরতাদ বলে আখ্যায়িত করেন।

কারণ, ওহহাবি আন্দোলনের অনুসারীদের দৃষ্টিতে উসমানীরা ছিল মুশরিক। তারা উসমানী খিলাফতকে কোনো ইসলামী রাষ্ট্র বা খিলাফত হিসেবে অভিহিত করত না, বরং একে বলত “আদ-দাওলাতুল উসানিয়্যাহ” (মূর্তিপূজক রাষ্ট্র) বা “আদ-দাওলাতুল কাফিরাহ” (কাফের রাষ্ট্র)। এ বিষয়ে ঐ সময়ের ওহহাবি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা, অগ্রদূত ও বিশিষ্ট নেতাদের পক্ষ থেকে অসংখ্য ফাতাওয়া ও বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল। সমসাময়িক এক পরিচিত ওহহাবি আলেম নাসির ইবন হামাদ আল-ফাহদ তাঁর “উসমানী রাষ্ট্র ও শাইখ মুহাম্মদ ইবন আবদুল ওহহাবের দাওয়াতের এর প্রতি অবস্থান” প্রবন্ধে এসব মতামতের কিছু উল্লেখ করেছেন।

ওহহাবি আলেমদের রচিত অধিকাংশ গ্রন্থ, প্রবন্ধ ও লেখায় উসমানী খিলাফতকে এককভাবে কাফের রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

তবে সমসাময়িক ওহহাবি আলেম ও মুজাহিদগণ, যারা অপেক্ষাকৃত সংযত মনোভাব পোষণ করেন—যারা মুসলিম উম্মাহর সামগ্রিক দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করেন, রাজনৈতিক ও জিহাদি অন্তর্দৃষ্টি রাখেন এবং উসমানী খিলাফতের পতনের বিপর্যয়কর পরিণতি অনুধাবন করেন—তারা আল-সাউদদের ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের সঙ্গে সহযোগিতার ভূমিকা কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন।

উসমানী খিলাফতের ভূমিকা

মুসলিম উম্মাহর দুর্বলতার এই সময়ে, বহু বাস্তব ও আদর্শগত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, উসমানী খিলাফত মুসলিম বিশ্বের শেষ আশ্রয় ও আশা হিসেবে অবশিষ্ট ছিল। কাফের বিশ্ব এই শেষ আশ্রয়কেও নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, যার লক্ষ্য ছিল—
– ইসলামী বিশ্বকে ছোট ছোট বিভক্ত সত্তায় পরিণত করা।
– প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
– ইসলামী শরীয়াহর স্থানে সেক্যুলার, মানবনির্মিত আইন প্রবর্তন।
– দুর্বল, স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা ও একনায়ক প্রতিষ্ঠা করা, যারা ব্যক্তিগত, আঞ্চলিক ও পাশ্চাত্যের স্বার্থকে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের ওপরে স্থান দিত।
– মুসলিম উম্মাহকে একক নেতৃত্ব ও কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব থেকে বঞ্চিত করা।

ফলে মুসলিম উম্মাহ একক নেতৃত্ব ও কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।

কাফেরদের মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহায়তা: শাইখ মুহাম্মদ ইবন আবদুল ওহহাবের অবস্থান

শাইখ মুহাম্মদ ইবন আবদুল ওহহাব রহিমাহুল্লাহ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফেরদের সাহায্য বা পাশে দাঁড়ানো (যা “মুযাহারাহ ‘আলা আল-মুসলিমীন” নামে পরিচিত) নিঃসন্দেহে কুফরি। তিনি একে ঈমানের নাসিখ (নাওয়াকিদুল ইমান)-এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। নাওয়াকিদুল ইমান সম্পর্কিত তাঁর একটি রিসালায় তিনি এটিকে অষ্টম নাসিখ হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছেন—
(الثامن): مظاهرة المشركين ومعاونتهم على المسلمين، والدليل قوله تعالى: ﴿وَمَنْ يَّتَوَلَّهُمْ مِّنْكُمْ فَاِنَّهٗ مِنْهُمْؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا يَهْدِى الْقَوْمَ الظّٰلِمِيْنَ﴾

অনুবাদ:
“অষ্টম নাসিখ: মুশরিকদের মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহায়তা ও সহযোগিতা করা। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী—
‘আর তোমাদের মধ্যে যে কেউ তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, নিশ্চয়ই সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিম জাতিকে হিদায়াত দেন না।’ (সূরা মায়িদাহ ৫:৫১)”

যদিও মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফেরদের সাহায্য করা নিঃসন্দেহে জঘন্য ও অপরাধমূলক কাজ, প্রাচীন আলেমগণ একে ঈমান-নাশক কাজ হিসেবে গণ্য করেননি। তারা একে কবিরাহ গুনাহ হিসেবে বিবেচনা করেছেন, যা কেবলমাত্র তখনই কুফরে পরিণত হয় যদি তা কোনো বিকৃত আকিদা থেকে উদ্ভূত হয়।

যদি এ কাজ অন্য কারণে সংঘটিত হয় (যেমন রাজনৈতিক বা কৌশলগত পরিস্থিতির কারণে), বিশ্বাসগত বিকৃতি ছাড়া, তবে প্রাচীন আলেমরা একে কুফরি বা রিদ্দাহ বলে আখ্যায়িত করেননি। এ প্রসঙ্গে শাইখ মুহাম্মদ ইবন আবদুল ওহহাব ভুল করেছিলেন। যদিও পরবর্তীকালে কিছু আলেম এ কর্মকে কুফরি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন, কিন্তু তাদের বক্তব্য অনেক সময় অতিরিক্ত কঠোর বা অস্পষ্ট ছিল। কিছু ক্ষেত্রে এমনকি এ আলেমগণও পূর্বসূরিদের সর্বসম্মত অবস্থানের সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ মত গ্রহণ করেছেন।

চলবে…

Exit mobile version