খাওয়ারিজদের পরিচয় | চতুর্থ পর্ব

✍🏻 রাশেদ শফীক

নহরাওয়ানে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও খাওয়ারিজদের সংলাপ

নহরাওয়ানে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও খাওয়ারিজদের মধ্যে একাধিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। যখন তিনি তাদের বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, তারা নিম্নলিখিত আপত্তিসমূহ উত্থাপন করে—

১. জামাল (উষ্ট্র) যুদ্ধে নারীদের ও শিশুদের যুদ্ধলব্ধ সম্পদের (গনীমাহ) অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি; অথচ অর্থসম্পদ বিতরণ করা হয়েছে, কেন?

২. সিফফিনে হযরত মু‘আবিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে কেন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর নাম থেকে “আমীরুল মুমিনিন” উপাধি পরিহার করা হলো এবং কেন তাঁর (হযরত মু‘আবিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহু) প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা হলো?

৩. হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু সালিসদের উদ্দেশে বলেছিলেন: “যদি আমি খিলাফতের উপযুক্ত হই, তবে আমার অধিকার প্রতিষ্ঠা করো।” তাদের মতে, এই উক্তি তাঁর খিলাফতের বৈধতা সম্পর্কে সংশয়ের ইঙ্গিত বহন করে।

৪. যে অধিকার তাঁর স্বতঃসিদ্ধ ও নিরঙ্কুশ ছিল, তার নিষ্পত্তির জন্য তিনি সালিসি প্রক্রিয়ায় সম্মত হলেন কেন?

হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতিতর্ক ও খণ্ডন

হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের আপত্তিসমূহ যথাযথ যুক্তি ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে খণ্ডন করেন—

প্রথম আপত্তির জবাবে তিনি বলেন, বসরার সরকারি কোষাগার থেকে ত্বালহা ও যুবাইর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) যে সম্পদ গ্রহণ করেছিলেন, তা খুবই সামান্য ছিল। এছাড়া, নারী ও শিশুরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি এবং তারা ইসলামী শাসনের অধীনস্থ মুসলিম নাগরিক ছিল।

দ্বিতীয় আপত্তির প্রতিক্রিয়ায় তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুদাইবিয়ার সন্ধির প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন, যেখানে তাঁর নবুয়তের পদবি পরিহার করা হয়েছিল। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, একদিন আমি তাদের সঙ্গে অনুরূপ একটি চুক্তি সম্পাদন করব।”

তৃতীয় আপত্তির ব্যাখ্যায় তিনি স্পষ্ট করেন যে, সালিসদের মনোনয়ন কেবল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ছিল এবং এটি তাঁর খিলাফতের বৈধতা সম্পর্কে কোনো সংশয়ের ইঙ্গিত বহন করে না। তিনি নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যুগে নজরানের খ্রিস্টানদের সঙ্গে সংঘটিত মুবাহালার ঘটনাকে এর উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন, যেখানে উভয় পক্ষ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সম্মত হয়েছিল।

চতুর্থ আপত্তির খণ্ডনে তিনি বলেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং বানু কুরায়জা গোত্রের বিচারের জন্য সা‘দ ইবনু মু‘আয রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সালিস হিসেবে মনোনীত করেছিলেন, যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই ছিল।”

খারিজিদের বিদ্রোহের কারণ

খারিজিদের বিদ্রোহের কারণসমূহ নিম্নরূপ—

১. খিলাফত সংক্রান্ত মতপার্থক্য
খাওয়ারিজদের বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল নেতৃত্ব সংক্রান্ত তাদের কঠোর ও অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি। তারা বিশ্বাস করত, সে সময়কার শাসকগণ তাদের নির্ধারিত কঠোর মানদণ্ড অনুসারে খিলাফতের উপযুক্ত ছিলেন না। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত মু‘আবিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর মধ্যকার সংঘাতকে তারা ক্ষমতার লড়াই হিসেবে চিহ্নিত করে এবং উভয়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

২. সালিসের ইস্যু
খাওয়ারিজরাই প্রথমে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সালিস গ্রহণ করতে বাধ্য করে।  এটি সংঘটিত হওয়ার পর, (যখন রায় তাদের প্রত্যাশার বিরুদ্ধে যায়) তারা তাকে সিদ্ধান্ত ত্যাগ করে পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করার দাবি জানায়, যার জবাবে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু দৃঢ়ভাবে অবস্থান নেন।

৩. শাসকদের উপর যুলুমের অভিযোগ ও সমাজে পাপাচারের বিস্তার
তারা প্রচার করত যে, শাসকগণ যুলুম চালাচ্ছে এবং সমাজ নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অথচ বাস্তবে খাওয়ারিজরা নিজেদের বিদ্রোহের মাধ্যমে অধিকতর রক্তপাত, বিশৃঙ্খলা ও অবিচারের জন্ম দিয়েছিল।

৪. অর্থনৈতিক অসন্তোষ ও বিদ্বেষ
খাওয়ারিজদের বিদ্রোহের পেছনে অর্থনৈতিক কারণও একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল। যুল-খুয়াইসরাহ নামক ব্যক্তি, যে প্রথমবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেছিল, সেই চরমপন্থী মানসিকতা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করেছিল। তারা হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করত এবং তাঁর শাহাদাতের পর তারা রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুটপাট করে ও হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে।

Exit mobile version