ইবাদিয়া সম্প্রদায়ের আকীদা
বিশ্বাস ও মতাদর্শের প্রবাহমান ইতিহাস সাক্ষী যে, কতিপয় গোষ্ঠী মূলধারার সঠিক আকীদা থেকে বিচ্যুত হয়ে এমন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে, যা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের প্রতিষ্ঠিত পথের পরিপন্থী। তাদের অনেকে যুক্তিবাদের নামে স্বতঃসিদ্ধ সত্যের অপলাপ করেছে, আবার কেউ কেউ ফিকহ ও ইলমের কতিপয় বিষয়ে এমন বক্তব্য পেশ করেছে, যা সত্যের সঙ্গেও সাযুজ্যপূর্ণ। এভাবেই কখনো তাদের দর্শনে সত্যের আভাস পাওয়া যায়, কখনো তা সম্পূর্ণ বিপথগামীতায় পর্যবসিত হয়।
পূর্ববর্তী পর্বে ইবাদিয়াদের পরিচয় ও তাদের খাওয়ারিজদের শাখা হওয়া নিয়ে বিশদ পর্যালোচনা করা হয়েছিল। এবার আমরা তাদের বিশ্বাসসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করবো, যেখানে তারা মূলধারার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং যেখানে তাদের কোনো কোনো দৃষ্টিভঙ্গি সুন্নাহর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
১. আল্লাহ তাআলার সিফাত (গুণাবলি) বিষয়ক আকীদা
ইবাদিয়ারা এই বিষয়ে দুটি পৃথক ধারায় বিভক্ত:
প্রথম দল: তারা আল্লাহর সিফাত সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে এই ভেবে যে, সিফাতকে স্বীকার করা হলে তা সৃষ্টির সাদৃশ্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাদের মতে, আল্লাহ তাআলা এমন সত্তা, যিনি সম্পূর্ণ নির্দিষ্ট সিফাতের উর্ধ্বে।
দ্বিতীয় দল: তারা আল্লাহর সিফাতকে স্বীকার করলেও, এগুলোকে সত্তার সাথে একীভূত হিসেবে ব্যাখ্যা করে। তারা বলেন, আল্লাহ নিজ সত্তার মাধ্যমেই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও সর্বশ্রোতা। তবে তারা কুরআন ও হাদীসে প্রমাণিত “হাত” (يد), “শ্রবণ” (سمع) ইত্যাদি সিফাতকে সৃষ্টির গুণাবলির সাথে মিলিয়ে ফেলার ভয়ে প্রত্যাখ্যান করে।
প্রকৃতপক্ষে এটি সিফাতের অস্বীকারেরই একটি প্রকার, যদিও তারা এটিকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করে যেন তারা সৃষ্টির সাথে আল্লাহর কোনো সাদৃশ্য নিরূপণ করছে না। ইবাদিয়াদের অন্যতম বিদ্বান আল-ওয়ারজিলানি এই দর্শনকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং আল্লাহর সিফাতের প্রতি ঈমান রাখা ব্যক্তিদের তিনি মূর্তিপূজকদের সাথে তুলনা করেছেন।
২. আল্লাহ তাআলার দর্শনীয়তার অস্বীকার
ইবাদিয়াদের বিশ্বাস যে, আল্লাহকে দৃষ্টি দ্বারা দেখা সম্ভব নয়। তারা যুক্তি দেয় যে, মানুষের পক্ষে আল্লাহকে দেখা বোধগম্যতার সীমানার বাইরের বিষয়। এ প্রসঙ্গে তারা নিম্নোক্ত আয়াতকে দলিল হিসেবে পেশ করে:
”لا تدركه الأبصار وهو يدرك الأبصار“
(তাঁকে চক্ষুগুলো আয়ত্ত করতে পারে না, কিন্তু তিনি চক্ষুগুলোকে আয়ত্ত করেন।) —সূরা আন’আম: ১০৩
তারা এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মুতাযিলা মতবাদ অনুসরণ করেছে।
তবে প্রকৃত অর্থে, এই আয়াত আল্লাহর দর্শনীয়তাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে না; বরং এখানে বোঝানো হয়েছে যে, কোনো চক্ষুই আল্লাহকে এমনভাবে পরিবেষ্টন করতে পারবে না, যেভাবে একটি বস্তুকে সম্পূর্ণরূপে ধারণ করা যায়।
এছাড়া, তারা নিম্নলিখিত আয়াতকে তাদের দাবির পক্ষে ব্যবহার করে:
> “قال رب أرني أنظر إليك قال لن تراني ولكن انظر إلى الجبل فإن استقر مكانه فسوف تراني”
(মূসা বললেন: “হে আমার রব! আমাকে আপনার দর্শন দিন!” আল্লাহ বললেন: “তুমি আমাকে দেখতে পারবে না। তবে পর্বতের দিকে তাকাও, যদি তা নিজের স্থানে স্থির থাকে, তবে তুমি আমাকে দেখতে পারবে।”) —সূরা আ’রাফ: ১৪৩
বাস্তবে, এই আয়াত আল্লাহর দর্শনীয়তাকে অস্বীকার করে না; বরং এটি দুনিয়ায় আল্লাহকে দেখার অসম্ভবতাকে নির্দেশ করে, আর কিয়ামতের দিন এই দর্শন সম্ভবপর হবে।
৩. কুরআনের ‘মাখলুক’ হওয়া সংক্রান্ত বিশ্বাস
ইবাদিয়ার কতিপয় আলেম, যেমন ইবনু জামি ও আল-ওয়ারজিলানি, কুরআনের মাখলুক (সৃষ্ট বস্তু) হওয়া সংক্রান্ত মতবাদকে অপরিহার্য বিশ্বাস বলে ঘোষণা করেছে। তাদের মতে, যে এই মতবাদকে অস্বীকার করবে, সে ইবাদিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নয়।
অন্যদিকে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের বিশ্বাস হলো, কুরআন হলো আল্লাহর কালাম (বাক্য) এবং এটি কোনো সৃষ্ট বস্তু নয়। ইমাম আহমদ ইবনু হামবাল (رحمه الله) এই বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। তবে ইবাদিয়ার মধ্যে কিছু আলেম যেমন আবু নাযির আল-উমানি ও “আল-আদিয়ান” গ্রন্থের লেখক কুরআনের সৃষ্ট বস্তু হওয়ার মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
৪. তাকদীর (নিয়তি) সংক্রান্ত বিশ্বাস
এই বিষয়ে ইবাদিয়ারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সাথে ঐক্যমত পোষণ করে।
৫. কবরের শাস্তি
ইবাদিয়াদের মধ্যে এ বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে। একটি দল কবরের শাস্তিকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে, যা খাওয়ারিজদের মতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তবে অপর দল কবরের শাস্তির বাস্তবতা স্বীকার করে। অথচ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের বিশ্বাস হলো, কবরের শাস্তি ও নিয়ামত উভয়ই বাস্তব, যা কুরআন ও হাদীসে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত।
৬. জান্নাত, জাহান্নাম, হাউজে কাউসার ও ফিরিশতাদের প্রতি ঈমান
ইবাদিয়া বিশ্বাস করে যে, জান্নাত ও জাহান্নাম বিদ্যমান, হাউজে কাওসার সত্য, এবং তারা ফিরিশতা ও আসমানি কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান রাখে।
৭. শাফা‘আত (সুপারিশ)
তারা কেবল নেককার মুমিনদের জন্য শাফা‘আতকে স্বীকার করে, কিন্তু পাপী মুমিনদের জন্য শাফা‘আতের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে।
৮. মীযান (পাপ-পূন্য পরিমাপের পাল্লা)
তারা কিয়ামতের দিনে বাস্তব পাল্লায় আমল মাপার ধারণাকে অস্বীকার করে এবং মনে করে যে, আল্লাহ তাআলা শুধুমাত্র নেক ও বদ আমলের মধ্যে পার্থক্য করবেন, কিন্তু কুরআন ও হাদীসে উল্লিখিত বাস্তব “মীযান”-এর অস্তিত্ব তারা মানে না।
৯. তাকিয়া (ধর্মীয় বিশ্বাস গোপন করা)
অন্যান্য খাওয়ারিজদের বিপরীতে ইবাদিয়ারা তাকিয়াকে বৈধ মনে করে।