হারিয়ে যাওয়া অর্ধশতাব্দী

✍🏻 আবু উবায়দাহ ফযলি

গত এক যুগ ধরে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যখনই আফগানিস্তান নামটি উচ্চারিত হয়, সঙ্গে সঙ্গে মানবমনে দুটি প্রশ্ন জেগে ওঠে—এ কি সেই যুদ্ধদগ্ধ ধ্বংসস্তূপ? নাকি সেই দারিদ্র্যের আবাসভূমি? অথচ সমগ্র পৃথিবী সুস্পষ্টভাবে অবগত, এই দুর্ভাগ্যের অন্তরালে কোন শক্তি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আফগানরাই এই ভূমির প্রকৃত উত্তরাধিকারী, যাদের ইতিহাস স্বাধীনতার জ্যোতি ও বীরত্বের গৌরবে পূর্ণ, যারা বরাবরই নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংকটের শিকার হয়েছে।

এই সংকটের শিকড় প্রোথিত বহিরাগত গোয়েন্দা সংস্থার ষড়যন্ত্র ও বিদেশি শক্তির কূটস্বার্থে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিল, সোভিয়েত আগ্রাসনের জন্য ভূমিকে সমতল করে দেওয়া, যা দেশটিকে এক ভয়াবহ প্রক্সি যুদ্ধে নিমজ্জিত করেছিল। মুজাহিদদের বিজয়ের পরও তারা এমন একটি সর্বসমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, যা জনমতের প্রতিফলন ঘটাতে পারত। ফলে মতবিরোধ তীব্রতর হয়ে ওঠে, যার অশুভ ছায়া যুগের পর যুগ আফগান জাতির নিয়তিকে আচ্ছন্ন করবে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিম্নরূপ—

১. আমেরিকার নেতৃত্বে দখলদারিত্ব
আমেরিকার পতাকার নিচে, ক্ষমতা ও সম্পদের মালিকরা এই ভূমিকে পদদলিত করেছিল। তাদের নির্মমতা এমন ভয়ঙ্কর ছিল যে, লেখকের কলম শঙ্কায় কেঁপে উঠত তাদের অপরাধ লিখতে গিয়ে। এটি কোনো অতিশয়োক্তি নয়, বরং দখলদারদেরই অন্তর থেকে স্বীকারোক্তির ধ্বনি উঠে এসেছিল। হামিদ কারযাই তার রাষ্ট্রপতিত্বকালে একাধিকবার প্রকাশ্যে বলেছিল, ন্যাটো বাহিনী রাতের অন্ধকারে মানুষের ঘরে হানা দিতো, অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করে তাদের গ্রেফতার করতো এবং অমানবিক নির্যাতনের শিকার করতো। কিন্তু এর থেকেও ভয়ঙ্কর ছিল, আফগান ভূমিকে আমেরিকার বোমার পরীক্ষাগার বানানো, যেখানে তারা ইচ্ছেমতো ভয়াল পরীক্ষা চালাতো।

কত শিশু রক্তে সিক্ত হলো, কত পরিবার অভিভাবকশূন্য হলো—এ নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ ছিল না। এর সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত আফগান মাটিতে “মাদার অব অল বম্বস”-এর পরীক্ষা।

২. দুর্নীতির ক্যান্সার
গণতান্ত্রিক শাসনের নামধারী ব্যবস্থায় দুর্নীতি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, যেন তা এক মরণব্যাধি ক্যান্সার। এ দুর্নীতি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শিরায় শিরায় প্রবাহিত হয়েছিল ভৌত ও নৈতিক উভয় দিক থেকে। সবার দৃষ্টিসীমায় স্পষ্ট ছিল, মন্ত্রণালয়গুলোতে, বিশেষত প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কী ভয়াবহ লুটপাট চলছিল। এমনকি কিছু নারীকে জেনারেলের পদে বসানো হয়েছিল, যাদের মানুষ ব্যঙ্গ করে ডাকতো—“জিগর জারনেলনি”।

আজ, সেই ব্যবস্থার পতনের পর, কেউ কেউ গণতন্ত্রের অন্ধকার দিনগুলোর কাহিনি শোনায় কীভাবে সরকারি দপ্তরে নৈতিক পতন সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল। তারা নিজেরাই বলে থাকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োগের একমাত্র মানদণ্ড ছিল নারীর বাহ্যিক রূপলাবণ্য। তাদের স্মৃতিতে সেই দিনগুলো রক্তাক্ত ক্ষতের মতো দগদগে হয়ে আছে।

৩. আফগান সংস্কৃতির বিস্মৃতি
এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই—আফগানিস্তান এমন এক অনন্য সংস্কৃতির ধারক, যাকে ইতিহাসবিদেরা সর্বদাই গৌরবের সঙ্গে স্মরণ করেছেন। কিন্তু দখলদারিত্বের অন্ধকারে, সেই সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে এবং পরিকল্পিতভাবে মুছে ফেলা হয়েছিল। সামরিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসীরা জনগণের অন্তর থেকে সেটি ছিনিয়ে নিয়েছিল। প্রথমে পরিবারে আঘাত হেনেছিল, পরে সমাজে। ফলাফল দাঁড়িয়েছিল পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে—কেউ লেনিনের মতো দাড়ি রাখতো, কেউ হিটলারের মতো গোঁফ।

নারীরা পর্যন্ত সেই স্রোতে ভেসেছিল; নগরীর রাস্তায় তারা হিজাব বা চাদর ছাড়া বের হতো, এবং গণতন্ত্রের স্লোগান তুলতো। গণমাধ্যমও এ নৈতিক মহামারী থেকে রক্ষা পায়নি। তারা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল কে বেশি অশ্লীলতা ছড়াতে পারে, আর পশ্চিমা তৈরি মঞ্চে বিজয়ী হতে পারে। এর দৃষ্টান্ত হলো বিভিন্ন প্রোগ্রাম হোস্টিং, Afghan Star এবং অনুরূপ অনুষ্ঠান, যেখানে আফগান নারীরা নৃত্যে মগ্ন হতো ও দেহ প্রদর্শন করতো।

তবুও আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, সমস্ত আফগান এই অর্ধশতাব্দীর প্রকৃত ভুক্তভোগী। দেশটি প্রতিটি দিক থেকেই নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল: অর্থনৈতিক নিঃস্বতা, সাংস্কৃতিক নিঃস্বতা, শিক্ষাগত নিঃস্বতা। উপরের উদাহরণগুলো কেবল সামান্য অংশমাত্র। যদি সমস্ত সমস্যাকে পূর্ণাঙ্গভাবে লিপিবদ্ধ করতে যাই, তবে বছর পর বছর ব্যয় হবে। কিন্তু আমাদের আলোচনার লক্ষ্য সেই হারিয়ে যাওয়া অর্ধশতাব্দী—যা আমরা বিগত বিশ বছরে দেশকে নবজাগরণের দিকে নিয়ে যেতে, অবকাঠামো নির্মাণে, বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে, খনি খাতে বিনিয়োগে ও উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হতে ব্যবহার করতে পারতাম।

কিন্তু তার পরিবর্তে, সেই বিশ্বাসঘাতক নেতারা—যারা যুগের পর যুগ এই মাজলুম জাতিকে দাসত্বে আবদ্ধ রেখেছিল, জাতির রক্ত চুষে নিয়েছে, মানুষের মুখের আহার কেড়ে নিয়েছে এবং কোটি কোটি নয়, বরং শত কোটি ডলারের সম্পদ সঞ্চয় করেছে। আর শেষ পর্যন্ত, প্রবাদবাক্যের মতোই—বিশ্বাসঘাতক সর্বদা ভীত, তাই সে স্থিতির বদলে পলায়নকেই অবলম্বন করে।

আফগানরা তাদের জীবনের অর্ধাংশ যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষে বিলীন করেছে, আর তাদের মাতৃভূমি আগ্রাসীদের হাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে, ইসলামী ইমারাতের বিজয়ের পর জনগণ ও ভূমি আজ শান্তি ও নিরাপত্তার আবেশে আবদ্ধ। আল্লাহর অনুগ্রহেই জনকল্যাণমূলক বিশাল প্রকল্প—কুশতেপা বাঁধ, কাসা-হাজার, টাপি, এবং অন্যান্য কাজ আরম্ভ হয়েছে, যা আমাদের স্বদেশবাসীর জন্য কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচন করেছে।

এই চার বছরে, যখন নির্মাণ মন্ত্রণালয়ের কল্যাণকর প্রকল্পগুলো পুনর্জীবন ও বাস্তবায়নের পথে এগিয়েছে, অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে তাকালে দেখা যায়, এর শিকড় হাজার বছরের ঐতিহ্যে প্রোথিত। আমরা এই প্রাপ্তির মর্যাদা দিই, এবং কৃতজ্ঞ হৃদয়ে তা স্বীকার করি।

Exit mobile version