পাকিস্তানের দ্বিমুখী নিরাপত্তা নীতি!

পাকিস্তান নিজেকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সম্মুখসারির ত্যাগী রাষ্ট্র হিসেবে জাহির করে। কিন্তু সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণাদি এই দাবির বিপরীতে একটি স্ববিরোধী, জটিল ও উদ্বেগজনক বাস্তবতা তুলে ধরে। বিশেষ করে আফগানিস্তানে পরাজয় ও পিছু হটার পর পাকিস্তানে আইএস-কে (ISIS-K বা দাঈশ খোরাসান) এর ক্রমবর্ধমান প্রভাব শুধু আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যই বড় হুমকি নয়, বরং এটি পাকিস্তানের নিরাপত্তা নীতির দ্বিমুখী প্রকৃতি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে।

দাঈশ খোরাসানের মুখপাত্র সুলতান আযিয আযযামের গ্রেফতারি—যা কি না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নতুন নিরাপত্তা সমঝোতা ঘোষণার ঠিক পরপরই সামনে এসেছে, এই সন্দেহকে আরও জোরালো করে যে, পাকিস্তান এখনও “নির্বাচিত সন্ত্রাসবিরোধী নীতি” অনুসরণ করছে।

এই পরিস্থিতি পাকিস্তানের নিরাপত্তা নীতির একটি স্পষ্ট উদাহরণ তুলে ধরে, যেখানে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই মূলত লোক দেখানো স্লোগানে রূপ নিয়েছে। তাদের আসল মনোযোগ এখন বাণিজ্যিক নিরাপত্তা, কৌশলগত চাপ সৃষ্টি এবং বিশ্ববাসীর চোখে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার দিকে। পাকিস্তানে দাঈশ খোরাসানের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি, তাদের গোপন আস্তানা এবং সময় সময় দেওয়া রাজনৈতিক ঘোষণাগুলো স্পষ্ট করে যে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা চক্র এখনও “ভালো” এবং “মন্দ” সন্ত্রাসীর ধারণা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি।

এই জটিল বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে, বিশ্ব সম্প্রদায় এবং অঞ্চলের দেশগুলোর উচিত আফগান সরকারের মতো পাকিস্তানের দ্বিমুখী নিরাপত্তা নীতির বিরুদ্ধে একটি স্পষ্ট, নিরপেক্ষ এবং নীতিগত অবস্থান নেওয়া। কারণ, যতক্ষণ পর্যন্ত সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই প্রকৃত, স্বচ্ছ এবং বৈষম্যহীন না হবে, ততক্ষণ এই অঞ্চল নিরাপত্তাহীনতা, হস্তক্ষেপ এবং রক্তপাতের শিকার হতেই থাকবে।

দাঈশ খোরাসান (ISIS-K): উত্থান ও মতাদর্শ
দাঈশ খোরাসান ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে আত্মপ্রকাশ করে এবং নিজেদের ইরাক ও সিরিয়ায় সক্রিয় মূল দাঈশ-এর আঞ্চলিক শাখা হিসেবে পরিচয় দেয়। এই গোষ্ঠীর প্রভাব আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অংশে ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুতই তারা উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

তারা একটি কঠোর ও সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ গ্রহণ করে, যার লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় ও জাতিগত বিভেদকে উসকে দেওয়া এবং অন্যান্য জিহাদি আন্দোলনকে অবিশ্বস্ত প্রমাণ করা। এই গোষ্ঠী বেসামরিক নাগরিক, ধর্মীয় উপাসনালয়, সংখ্যালঘু এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর ভয়াবহ হামলা চালিয়ে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।

আফগানিস্তানে দাঈশ খোরাসানের পরাজয়
ইসলামি ইমারাত (তালিবান) পুনরায় ক্ষমতা গ্রহণের পর দাঈশ খোরাসান আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ইসলামি ইমারাত কালক্ষেপণ না করে এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সামরিক অভিযান শুরু করে।
এই অভিযানের ফলাফল ছিল উল্লেখযোগ্য:
১. উচ্চপদস্থ নেতাদের গ্রেফতার বা খতম করা।
২. নিয়োগ, প্রশিক্ষণ এবং লজিস্টিক নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা।
৩. আর্থিক উৎস ও বিদেশি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা।
৪. তাদের প্রোপাগান্ডা ও মিডিয়া কাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া।
৫. যোদ্ধাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া এবং তাদের আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করা।

এর ফলে দাঈশ খোরাসান শুধু হামলার সক্ষমতাই হারায়নি, বরং তাদের সাংগঠনিক কাঠামোও ভেঙে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও নিশ্চিত করেছে যে, দাঈশ এখন আর কোনো সুসংগঠিত বিদ্রোহী শক্তি নয়।

পাকিস্তানে দাঈশ উপাদানগুলোর স্থানান্তর
আফগানিস্তানে অভিযানের মুখে টিকে থাকতে না পেরে এই গোষ্ঠীর অবশিষ্টাংশ কোথায় গেল? বিভিন্ন আঞ্চলিক নিরাপত্তা রিপোর্ট ও প্রমাণ অনুযায়ী, পাকিস্তান দাঈশ খোরাসানের অবশিষ্ট সদস্যদের প্রধান আস্তানায় পরিণত হয়েছে। এই স্থানান্তর কোনো কাকতালীয় ঘটনা ছিল না, বরং এটি ছিল একটি পরিকল্পিত ও কৌশলগত কৌশল।
মূল পয়েন্টগুলো এই সত্যকে স্পষ্ট করে:
• দাঈশ সদস্যদের পাকিস্তানের উপজাতীয় এলাকা, খাইবার পাখতুনখোয়া, বেলুচিস্তান এবং পাঞ্জাবের কিছু শহরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
• সেখানে তাদের নিরাপদ আস্তানা, চিকিৎসা, পরিচয়পত্র এবং যোগাযোগের মাধ্যম দেওয়া হয়েছে।
• সীমান্ত পারাপার এবং পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বা কৌশলগত সমর্থন ছাড়া এমন তৎপরতা অসম্ভব। ফলে এই আশঙ্কা আরও দৃঢ় হয়েছে যে, পাকিস্তানি প্রশাসন হয়তো নিজেদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দাঈশকে ব্যবহার করার জন্য “কৌশলগত নীরবতা” পালন করছে।

পাকিস্তানি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের দ্বিমুখী আচরণ
পাকিস্তানের সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দীর্ঘকাল ধরে একটি বড় অভিযোগের সম্মুখীন, তা হলো সশস্ত্র গোষ্ঠীদের প্রতি তাদের “নির্বাচনমূলক আচরণ”। তাদের কাছে সশস্ত্র গোষ্ঠী দুই প্রকার: “বন্ধু” এবং “শত্রু”।

বন্ধু গোষ্ঠীগুলো তারাই, যারা পাকিস্তানের কৌশলগত স্বার্থে (যেমন ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি বা আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার) কাজ করে। তাদের হয় নিরাপদ রাখা হয়, অথবা প্রয়োজনে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

সুলতান আযিয আযযামের গ্রেফতারি এই দ্বিমুখী নীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের কৌশলগত সম্পর্কের আলাপ শুরু হলো, তখনই তাকে গ্রেফতার দেখানো হলো। এটি প্রমাণ করে যে, তারা সশস্ত্র গোষ্ঠীদের নিরাপত্তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।

আল মিরসাদের রিপোর্ট ও তথ্যপ্রমাণ
নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থা ‘আল মিরসাদ’ তাদের প্রতিবেদনে দাঈশ ও পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সহযোগিতার তথ্য উন্মোচন করেছে। তাদের প্রধান পয়েন্টগুলো হলো:
১. ট্রানজিট রুট: গ্রেফতারকৃত সদস্যরা স্বীকার করেছে যে, পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সহায়তায় তাদের আফগানিস্তানে নাশকতা চালানোর জন্য পাঠানো হয়েছে।
২. পরিকল্পনা কেন্দ্র: আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় সাম্প্রতিক হামলার পরিকল্পনা পাকিস্তানের মাটি থেকেই করা হয়েছে।
৩. অবাধ চলাচল: দাঈশ নেতারা পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে অত্যন্ত স্বাধীনভাবে চলাফেরা করছেন, যা কোনো চুক্তির ইঙ্গিত দেয়।
৪. বিশ্বব্যাপী প্রভাব: তাজিকিস্তান সীমান্তে চীনা নাগরিকদের ওপর হামলার সাথে পাকিস্তানের নেটওয়ার্কের যোগসূত্র পাওয়া গেছে।

আফগানিস্তানের আনুষ্ঠানিক অবস্থান
ইসলামি ইমারাত আফগানিস্তানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বারবার দাবি করেছেন যে, দাঈশ নেতারা পাকিস্তানে অবস্থান করছেন। তিনি এই সন্ত্রাসীদের হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছেন এবং স্পষ্ট করেছেন যে, আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার পেছনে পাকিস্তানের ভূমিকার প্রমাণ তাদের কাছে রয়েছে।

গ্রেফতারের গল্প: সময় ও বৈপরীত্য
সুলতান আযিয আযযামের গ্রেফতারি নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা রয়েছে। পাকিস্তানি মিডিয়া দাবি করেছে তাকে সীমান্ত থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে, কিন্তু এর কোনো নিরপেক্ষ প্রমাণ নেই। উল্টো সাংবাদিক আদিল রাজা আগেই দাবি করেছিলেন যে, এই নেতারা অনেক আগে থেকেই পাকিস্তানি সেনার জিম্মায় ছিল। মার্কিন সফরের সময় সেনাপ্রধানের জন্য একটি “সাফল্য” দেখানোর জন্যই এই সময়কে বেছে নেওয়া হয়েছে।

উপসংহার
পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদকে নীতিগতভাবে দমনের বদলে একটি “ডিল” বা চুক্তির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। তারা সন্ত্রাসবাদকে লালনও করে আবার তা বিক্রি করে আন্তর্জাতিক সুবিধা ও অর্থ আদায় করে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নিরাপত্তা নীতি বৈপরীত্য ও সাময়িক স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করে, শেষ পর্যন্ত তারা সেই আগুনেই নিজেরা ভস্মীভূত হয়।

Exit mobile version