রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর যুদ্ধজীবন: মানবজাতির জন্য শিক্ষা | ত্রয়োদশ পর্ব

✍🏻 আবু রাইয়ান হামিদী

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে মক্কার বাহিনীর ২৪ জন নিহত মুশরিকের লাশ বদরের এক কূপে নিক্ষেপ করা হয়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভ্যাস ছিল, যখন কোনো যুদ্ধে বিজয় লাভ করতেন, তখন তিনি সেই ময়দানে তিন দিন অবস্থান করতেন। বদরের যুদ্ধের তৃতীয় দিনে তিনি সেই কূপের পাশে গমন করেন, যেখানে মুশরিকদের লাশ ফেলা হয়েছিল। তিনি তাদের প্রত্যেককে নিজ নাম ও পিতার নাম সহকারে সম্বোধন করে বললেন:
“هَلْ وَجَدْتُّمْ مَا وَعَدَ رَبُّكُمْ حَقًّا؟ فَإِنِّي وَجَدْتُ مَا وَعَدَنِي رَبِّي حَقًّا”
অর্থ: তোমরা কি তোমাদের রবের প্রতিশ্রুতি সত্য বলে পেয়েছো? আমি তো আমার রবের প্রতিশ্রুতি সত্য বলে পেয়েছি।

এ সময় হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রশ্ন করলেন: হে আল্লাহর রসূল! আপনি কি মৃত লাশগুলোর সঙ্গে কথা বলছেন?

তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “সেই সত্তার কসম! যাঁর হাতে আমার প্রাণ। তোমরা যা শুনছো, এরা তা-ই শুনছে; কিন্তু তারা উত্তর দিতে পারছে না।” এরপর তিনি মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।

মক্কার পরাজিত সৈন্যরা উপত্যকা ও মরুভূমিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রত্যেকেই চেষ্টায় ছিল যেন মক্কায় কোনোভাবে পৌঁছাতে পারে, কিন্তু অধিকাংশের পথঘাটই জানা ছিল না। সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি মক্কায় পৌঁছে পরাজয়ের সংবাদ দেয়, তিনি ছিলেন হুসাইমান ইবনে আবদুল্লাহ। তিনি এসে মক্কাবাসীকে পরাজয়ের দুঃসংবাদ শুনান। লোকেরা তাদের নিহতদের জন্য হাহাকার করে কাঁদতে থাকে, কিন্তু তারপর কান্না বন্ধ করে দেয়, যেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের শোক শুনে আনন্দিত না হন।

মক্কার নেতাদের অন্যতম আবু লাহাব তখন মক্কাতেই ছিল। পরাজয়ের সংবাদ তাকে এমনভাবে অপমানিত করেছিল যে, দুর্বল ও অসহায় লোকেরাও তার কলার চেপে ধরতে সাহস দেখায়। এরপর সে সাত দিন বেঁচে ছিল। এরপর ‘আদসা’ নামক একটি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। (আদসা ছিল এক প্রকার ফোড়া বা প্লেগ, যেটিকে আরবরা অশুভ মনে করত)। মৃত্যুর পর কেউ তার মরদেহ স্পর্শ করতেও রাজি হয়নি। তিন দিন পর, লোকে কটূক্তি করতে লাগলে তার ছেলেরা বাধ্য হয়ে একটি গর্ত খনন করে দূর থেকে লাঠি দিয়ে তার মরদেহ সেখানে ঠেলে ফেলে দেয় এবং উপর থেকে মাটি চাপা দেয়।

এটাই ছিল তাদের পরিণাম, যারা মক্কায় দুর্বল মুসলিমদের উপর নানা নির্যাতন চালাত, শুধুমাত্র ইসলাম গ্রহণের অপরাধে। কিন্তু এই পথভ্রষ্ট জাতি আল্লাহর শক্তিকে উপেক্ষা করেছিল এবং তাঁর শাস্তিকে ভুলে গিয়েছিল।

মক্কার প্রতিটি ঘর ও গলি ছিল শোকে নিমজ্জিত। কেনইবা হবে না, যখন একটি জাতির ডজনখানেক নেতা নিহত হয়, তাদের অহংকার ধূলায় মিশে যায় এবং প্রতিটি ঘরে থাকে শোক ও জানাজার আয়োজন— তখন পুরো মক্কাই তো শোকে ডুবে যাবে।

হায়! যদি তারা মৃত্যুর আগেই কুফরের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে ঈমানের আলোয় আশ্রয় নিত!

মদীনায় যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিজয়ের সংবাদ পৌঁছায়, তখন সাহাবাগণ তাঁর কন্যা ও হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর স্ত্রী হযরত রুকাইয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহার কবরে মাটি দিচ্ছিলেন। তিনি অসুস্থ ছিলেন, এ কারণেই নবীজি তাঁকে মদীনায় থেকে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

মুসলিম বাহিনী তখনও বদরের ময়দান থেকে পুরোপুরি ফিরেনি, এর মধ্যেই গনীমতের মাল বণ্টন নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। কেউ কেউ, যারা শত্রুদের ধাওয়া করেছিল, তারা নিজেকে গনীমতের উপযুক্ত মনে করত। যারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রক্ষায় নিয়োজিত ছিল, তারাও নিজেদের প্রাপ্য মনে করত। আবার যারা গনীমতের মাল সংগ্রহ করেছিল, তারাও নিজেদের অধিকারী ভাবত।

এ বিরোধের অবসান ঘটে ওহী নাযিল হওয়ার মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাযিল করেন:
“يَسْأَلُونَكَ عَنِ الأَنْفَالِ، قُلِ الأَنْفَالُ لِلَّهِ وَالرَّسُولِ، فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ…”
অর্থ: (হে নবী!) তারা আপনাকে গনীমতের সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলে দিন: এই সম্পদ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক সঠিক করো।

এরপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কার দিকে রওয়ানা হন, তখন ‘সাফরা’ নামক স্থানে সমস্ত গনীমত সমানভাবে সমস্ত সেনাবাহিনীর মাঝে বণ্টন করে দেন। ইমাম বুখারী ও ইমাম ইবনু জারীরের মতে, তাতে থেকে পঞ্চমাংশ পৃথক করা হয়েছিল। কোনো পক্ষই কোনো অভিযোগ করেনি। সবাই আল্লাহর আদেশ ও নবীজির বণ্টনে সন্তুষ্ট ছিলেন।

বদরের যুদ্ধে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ বা অনুমতি অনুযায়ী অংশগ্রহণ করতে না পারা আটজন সাহাবীকেও গনীমতের অংশ প্রদান করা হয়। তারা হলেন: হযরত উসমান ইবনু আফফান, তলহা ইবনু উবাইদুল্লাহ, সাঈদ ইবনু যাইদ, আবু লুবাবা, আসিম ইবনু আদি, হারিসা ইবনু হাতিব, হারিস ইবনু সোমা এবং খাওয়াত ইবনু যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুম।

সাফরার স্থানে বন্দীদের মধ্যে দুইজন— নজর ইবনু হারিস এবং উকবা ইবনু আবু মুয়াইতকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। এ দুজন ছিলেন এমন ব্যক্তি, যারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অতিমাত্রায় কষ্ট দিত। তাদের জিহ্বা ছিল বিষাক্ত, বাক্য ছিল তীব্র, এবং আচরণ ছিল ঘৃণ্য ও অবমাননাকর। তারা কথা ও কাজে নবীজিকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কোনো প্রচেষ্টা বাকি রাখেনি।

Exit mobile version