রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর যুদ্ধজীবন: মানবজাতির জন্য শিক্ষা | একবিংশ পর্ব

✍🏻 আবু রাইয়ান হামিদী

বদরের যুদ্ধের পর আরব উপদ্বীপে এর প্রভাব

বদরের মহাযুদ্ধ এক অনন্য জয়ের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছিল। এমন এক বিজয় যা আরবদের সামগ্রিক সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তিকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল। এই যুদ্ধ আরবদের বিস্মিত করে দেয়, বিশেষ করে ইয়াহুদিরা ও মুনাফিকরা এতে মোটেই সন্তুষ্ট ছিল না, কারণ এই বিজয়ের মাধ্যমে তাদের চক্রান্ত, প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রের পথে এক দুর্ভেদ্য বাঁধ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। তারা একা ছিল না, ইসলামের সব শত্রুই এরপর থেকে একযোগে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো এবং স্থির করল যে, ভবিষ্যতে তারা সম্মিলিতভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এবং তাদের কোনো ধরনের বিজয়ের সুযোগ দেবে না।

তবে, এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে গিয়ে প্রত্যেকে বেছে নিল পৃথক পৃথক কৌশল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এক—ইসলামের বিজয় রোধ করা, কিন্তু পথে ছিল ভিন্নতা। নিচে আমরা মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের সকল শত্রুর কৌশল সংক্ষেপে তুলে ধরছি:

১. মক্কার পরাজয়ের পর
মক্কার মুশরিকদের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল, তাদের নেতারা একে একে নিহত হয়েছিল। কিন্তু তারা এই বেদনা প্রকাশ করতে চায়নি। বরং তারা কৃত্রিমভাবে শান্তি দেখিয়ে এমনকি প্রকাশ্যে শোক প্রকাশেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। তবুও তাদের মন অন্তর্দহনে পুড়তে থাকল। ইসলামবিরোধী তাদের বিদ্বেষ প্রশমিত হয়নি, বরং আরও ঘনীভূত হলো। তারা সামগ্রিক প্রস্তুতি নিতে লাগল, সামরিক শক্তিকে পুনর্গঠন করল, বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে জোট বাঁধল, যার ফলশ্রুতিতে গাযওয়ায়ে উহুদ সংঘটিত হয়। ইনশাআল্লাহ, সে বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

এছাড়াও, মক্কায় ইসলাম ধর্মের ওপর আরও কঠোর বিধিনিষেধ জারি করা হয়। মক্কায় অবস্থানরত মুসলিমরা ভয়াবহ দমন-পীড়নের শিকার হয়। অনেকেই নিজের ইসলাম লুকিয়ে রাখত। কিন্তু কেউ প্রকাশ করলে তার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হতো, কোনোরূপ দয়া করা হতো না।

২. মদীনার বিজয়ের পর
মদীনার অবস্থা মক্কার বিপরীত রূপ ধারণ করে। সেখানে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত আরও মজবুত হয়। যারা এখনো ইসলাম গ্রহণ করেনি, তারা মুখে মুসলিম হওয়ার ভান করতে থাকে। অন্তরে তারা ইসলামের শত্রু হলেও বাহ্যিকভাবে নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করে। এদেরই বলা হয় মুনাফিক। তাদের নেতৃত্বে ছিল আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনু সালূল। সে তার সকল অনুসারীকে বলেছিল, “মুসলিম হও, কারণ এখন মুসলিমদের শাসন বলবৎ হয়েছে, আর কোনো উপায় নেই।” ফলে তার সমর্থকরা একে একে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়। এই মুনাফিকরা গোপনে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল এবং তাঁকে কষ্টদানে কোনো রকম কসুর করত না।

৩. ইয়াহুদির অবস্থান
হিজরতের পর মদীনায় মুসলিমদের সঙ্গে ইয়াহুদিদের এক সন্ধি সম্পন্ন হয়েছিল, যার মূল কথা ছিল—কোনো পক্ষ অপর পক্ষের শত্রু হবে না এবং একে অপরের শত্রুর সাহায্যও করবে না। মুসলিমরা ঐ চুক্তিকে অক্ষরে অক্ষরে মান্য করত। যদিও তারা তখন বিজয়ী শক্তি এবং ইয়াহুদিরা দুর্বল অবস্থানে ছিল, তবু ইসলামী ঈমানি আত্মমর্যাদা তাদের কোনো ধরণের অন্যায় পদক্ষেপ গ্রহণে বাধা দিত। কারণ, রাসূলুল্লাহ ﷺ সবসময় অঙ্গীকার রক্ষার শিক্ষা দিতেন।

কিন্তু ইয়াহুদিরা চুক্তি লঙ্ঘন করতে থাকে এবং তাদের অন্তরের লুকায়িত শত্রুতা বদরের বিজয়ের পর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এই সময়ে তাদের নেতৃত্বে ছিল কা’ব ইবনু আশরাফ, যে মুশরিকদের, বিশেষ করে মক্কার কুরায়শদের যুদ্ধের জন্য উস্কানি দিত। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র মুসলিমদের নজরে এলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক চরম শত্রুতায় পরিণত হয়। এর ফলশ্রুতিতে গাযওয়া বনু কইনুকা’, বনু নজীর এবং বনু কুরায়জা সংঘটিত হয়, যার মাধ্যমে মদীনা শরীফ ইয়াহুদিদের অপবিত্র অস্তিত্ব থেকে পবিত্র হয়ে যায়। ইনশাআল্লাহ, সেগুলোর বিস্তারিত আলোচনা নির্দিষ্ট স্থানে করা হবে।

৪. মরুবাসীদের প্রতিক্রিয়া
মদীনার আশেপাশের মরুবাসী যাযাবর গোত্রগুলোও বদরের এই বিশাল বিজয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত হওয়ায় তাদের ডাকাতি, লুটপাট ও রাহাজানি—যা তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান মাধ্যম ছিল, তা অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যায়।

তবে তাদের উদ্বেগ মক্কার মুশরিকদের মতো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ছিল না। তাদের মুসলিমদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল না কোনো ঈমানী বা আদর্শগত কারণে। বরং তাদের অস্বস্তির কারণ ছিল তাদের ডাকাতি ও লুটপাটের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া। ইসলাম তাদের অপরাধমূলক জীবনধারায় বাধা সৃষ্টি করেছিল, তাই তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

উপসংহার
বদরের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। শুধু বিজয়ের দিক থেকেই নয়, বরং এই বিজয়ের প্রতিক্রিয়ায় শত্রুদের একত্র হওয়া, তাদের কৌশলগত পরিবর্তন এবং ইসলামের বিরুদ্ধে পরবর্তী যুদ্ধাবলীর সূচনা—সবকিছুই এই যুদ্ধকে এক অনন্য ও ঐতিহাসিক অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে।

Exit mobile version