দাঈশ: না রইলো আন্দোলন, না রইলো রাষ্ট্র!

✍🏻 জুনাইদ যাহিদ

যদি আমরা দাঈশের কর্মকাণ্ডের একটি সামান্য পর্যালোচনা করি, তাহলে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই সংগঠন বা স্বঘোষিত রাষ্ট্র সাফল্যের প্রকৃত রূপরেখা থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে এবং নিজেদের ঘোষিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। যদি দাঈশকে একটি আন্দোলন হিসেবে দেখা হয়, তবে বোঝা যায় যে, এই আন্দোলন তার মৌলিক প্রেরণাদায়ক শক্তি, অর্থাৎ অনুসারী ও আদর্শিক সমর্থকদের সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলেছে এবং এমন শূন্যতায় পরিণত হয়েছে, যেমন কোনো শহর তার বাসিন্দাদের পরিত্যাগে বিরান হয়ে পড়েছে।

আর যদি আমরা দাঈশকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে দেখি, যেমন তারা নিজেদেরকে “الدولة الإسلامية في العراق والشام” নামে অভিহিত করেছিল, তাহলেও এটা পরিষ্কার যে, তারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের কোনো মৌলিক মানদণ্ড পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

রাষ্ট্র (দাওলাহ)-এর সংজ্ঞা কী?
রাজনৈতিক বিজ্ঞান বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে যদি বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয় এবং রাষ্ট্র সম্পর্কে লিখিত গ্রন্থগুলোর দিকে যদি আমরা নজর দিই, তাহলে এটা পরিস্কার হয়ে ওঠে যে, একটি রাষ্ট্র হলো এমন একটি রাজনৈতিক কাঠামো, যার নিজের কর্তৃত্ব থাকে, একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকে, এবং সে আইন, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও জনসেবার মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

এক প্রাচীন সংজ্ঞা অনুসারে, রাষ্ট্র হলো একটি আইনগত-রাজনৈতিক কাঠামো, যার স্থায়ী অস্তিত্ব রয়েছে, বৈধ কর্তৃত্ব আছে, এবং যা তার অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত সম্পর্কসমূহ পরিচালনা করে।
এই সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, দাঈশ রাষ্ট্রের সংজ্ঞা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।

উপরের সংজ্ঞার আলোকে যদি দাঈশের মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে দেখা যায় যে, দাঈশ কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন, কেননা তাদের নিয়ন্ত্রণে এমন কোনো ভৌগোলিক অঞ্চল নেই, যেটিকে তারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এবং যেখানে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে নিজেদের আইন প্রয়োগ করতে পারে।

রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক উপাদানসমূহ:
একটি কাঠামো, রাষ্ট্র বা দাওলাহ গঠনের জন্য কিছু মৌলিক উপাদান অপরিহার্য, যেগুলোর ভিত্তিতে রাষ্ট্র নিজস্ব কাঠামো এবং সরকার গঠন করে থাকে।

১. নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চল:
প্রত্যেক আন্দোলন বা কাঠামো, যা শাসনক্ষমতা কায়েম করতে চায়, তার প্রথম কর্তব্য হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, যাতে সেই ভূখণ্ডের সীমানার মধ্যে তারা নিজের আইন ও কর্মসূচি কার্যকর করতে পারে। ভৌগোলিক অঞ্চল রাষ্ট্রের একটি মৌলিক পূর্বশর্ত, যার ওপর কর্তৃত্ব না থাকলে রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়।

২. জনসংখ্যা:
একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজন হয় মানব জনসংখ্যার, অর্থাৎ এমন অধিবাসীদের যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাষ্ট্রের আইন মেনে চলে এবং তার সমর্থনে থাকে; শাসন যেন কেবল বলপ্রয়োগ, ভয় বা সামরিক দমন-পীড়নের মাধ্যমে না হয়।

৩. সরকার:
একটি সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক কাঠামোর প্রয়োজন, যা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং সামাজিক বিষয়াদি পরিচালনা করবে। যে রাষ্ট্রের নিজস্ব কার্যকর সরকার নেই, সে কখনোই তার জনগণ ও ভৌগোলিক অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।

৪. সার্বভৌমত্ব:
রাষ্ট্রের উচিত তার অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা, যেন অন্য কোনো শক্তির উপর নির্ভর করতে না হয় বা তাদের অধীনস্থ না থাকতে হয়। এই নীতির আলোকে যদি দাঈশের বাস্তবতা পর্যালোচনা করা হয়, তবে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, দাঈশ কখনোই একটি স্বাধীন সার্বভৌম কাঠামো ছিল না; বরং তা অন্য শক্তিগুলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়ে আসছিল, এবং এটি এক খোলামেলা বাস্তবতা।

উপরোক্ত আলোচনার আলোকে এটা স্পষ্ট যে, যদি দাঈশকে একটি আন্দোলন বলা হয়, তবে তা প্রাণহীন, নিষ্প্রভ ও ব্যর্থ এক সত্তা মাত্র। আর যদি তাকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে দেখা হয়, তবে তা রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক শর্তগুলোর একটিরও অধিকারী নয়। শেষ কথা হলো— দাঈশের চিন্তাগত ও বাস্তবিক ভিত্তির বিশ্লেষণে এটি এক খোলা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বৈ আর কিছু নয়। ভীতিকর, বর্বর, এবং দানবীয়।

Exit mobile version