খাওয়ারিজদের সঙ্গে হযরত উমার ইবন আবদুল আযীয রহ.–এর বিতর্ক!

✍🏻 ইয়াহইয়া যাহার

#image_title

উমার ইবন আবদুল আযীয রহ.-এর যুগে শুযাব আল হারুরীর নেতৃত্বে খাওয়ারিজরা আল জাজিরা অঞ্চলে বিদ্রোহ করে। উমার ইবন আবদুল আযীয রহ. তাদের কাছে মুহাম্মাদ ইবন যুবায়ের আল হানযালির মাধ্যমে একটি চিঠি পাঠান।

চিঠিটি পাওয়ার পর খারিজিরা উমার ইবন আবদুল আযীয রহ.-এর সাথে বিতর্কে জড়ানোর জন্য দুইজন দক্ষ ও প্রতিভাবান প্রতিনিধি পাঠায়, একজন ইথিওপিয়ান যার নাম আসিম এবং আরেকজন শাইবানি।

উমার ইবন আবদুল আযীয তাদের জিজ্ঞেস করলেন, “কেন তোমরা মুসলিম খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিলে?”
তাদের মধ্যকার আসিম নামে একজন উত্তর দিল, “হে উমার! আল্লাহর কসম, আপনার শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই, কারণ আপনি আল্লাহর যমিনে আদল ও ইনসাফ বাস্তবায়ন করেছেন। যাইহোক, আমাদের এবং আপনার মাঝে মতবিরোধের কারণ উল্লেখ করার পর আপনি যদি এটি গ্রহণ করেন, তবে আমরা আপনার সাথে থাকব এবং আপনি আমাদের সাথে থাকবেন। কিন্তু আপনি যদি তা প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক থাকবে না।”

উমার ইবন আব্দুল আযীয রহ. বললেন, “আমাকে বলো! এমন কী বিষয় যা তোমাদেরকে বিদ্রোহ করতে প্ররোচিত করেছিল?”
আসিম বলল, “আমরা দেখেছি যে আপনি আপনার পরিবারের প্রথার বিরোধিতা করেন, তাদের পথ ও প্রথার বিরুদ্ধে যাচ্ছেন এবং তাদের নীতিকে যুলুম হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে আপনি সঠিক পথে আছেন এবং তারা বিপথগামী ছিল, তাহলে প্রকাশ্যে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করুন এবং তাদের প্রতি লানত দিন। এটিই একমাত্র বিষয় যা আমাদের একত্রিত বা পৃথক করতে পারে।”

উমার ইবন আবদুল আযীয রহ. বললেন, “নিঃসন্দেহে আমি তোমার বক্তব্যের উদ্দেশ্য থেকে এতটুকু বুঝতে পেরেছি যে, তোমরা পার্থিব স্বার্থে বিদ্রোহ বেছে নাওনি, তোমরা আখেরাত কামনা করেছিলে, কিন্তু তোমরা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছো।
তিনি আরও বললেন, “আমি তোমাদেরকে কিছু জিজ্ঞাসা করি; আল্লাহকে উপস্থিত ও সাক্ষী মনে করে তোমার জ্ঞান অনুযায়ী সত্য উত্তর দাও। আবু বকর ও উমার রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমা কি তোমাদের পূর্বসূরিদের মধ্যে ছিলেন না? তোমরা কি তাদের ভালোবাসো না? তোমরা কি তাদের সাফল্য ও সমৃদ্ধির সাক্ষ্য দাও না?”
আসিম জবাব দিল, “হ্যাঁ, আবু বকর এবং উমার রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমা আমাদের নেতাদের মধ্যে ছিলেন এবং আমরা তাদের সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছি।”

উমার ইবন আবদুল আযীয রহ. জিজ্ঞেস করলেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর, যখন অনেক আরব মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল, তখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু কি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেননি? তাদের রক্তপাত করেননি? তাদের নারী ও শিশুদের বন্দী করেননি? তাদের সম্পত্তি গনিমত হিসেবে নেননি?”
আসিম উত্তর দিল, “নিঃসন্দেহে তা-ই ঘটেছিল।”

উমার ইবন আবদুল আযীয রহ. বললেন,“তুমি জানো যে, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর শাহাদাতের পর উমর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু খলিফা হন এবং তিনি সেই সমস্ত বন্দীদের মুক্তি দেন এবং তাদের গোত্রে ফেরত পাঠান।”
আসিম বলল, “নিঃসন্দেহে এমনটাই হয়েছিল।”

উমার ইবন আবদুল আযীয রহ. বললেন, “তাহলে কি আবু বকর উমারের সাথে কিংবা উমার আবু বকরের সাথে (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমা) বারাআত ঘোষণা করেছিলেন?
আসিম বলল, “না!”

উমার ইবন আবদুল আযীয রহ. বললেন, “তোমরা কি তাঁদের কোনো একজনের সাথে বারাআত ঘোষণা করো?
আসিম বলল, “না, মোটেই না!”

উমার ইবন আবদুল আযীয রহ. বললেন, “আচ্ছা বলো তো, নাহরাওয়ানের লোকেরা কি তোমাদের পূর্বপুরুষ নয়? তোমরা কি তাদেরকে ভালোবাসো না এবং তাদের সাফল্যের সাক্ষী দাও না?”
আসিম বলল, “হ্যাঁ, তারা আমাদের পূর্বপুরুষ এবং আমরা তাদের মুক্তির সাক্ষ্য দিচ্ছি।”

উমার ইবন আবদুল আযীয রহ. বললেন, “তোমরা জানো যে, কুফাবাসী যখন নাহরওয়ানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল, তখন তারা কারো উপর যুলুম করেনি এবং কোনোকে হত্যা করেনি।”
আসিম বলল, “হ্যাঁ, তাই।”

উমার ইবন আবদুল আযীয রহ. বললেন, “তুমি জানো যে, বসরার লোকেরা যখন নাহরওয়ানের লোকদের পিছনে বাহিনী প্রেরণ করেছিল, তখন তারা অনেক লোকের উপর অত্যাচার করেছিল। এমনকি নবীর একজন সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে হত্যা করেছিল, যিনি বনু কুতাইয়ার সদস্য ছিলেন। সেই বাহিনী বহু নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল।”
আসিম বললেন, “নিঃসন্দেহে তা-ই হয়েছিল।”

উমার ইবন আবদুল আযীয রহ. বললেন, “তোমার দল কি এই দুই দলের কোনো দল থেকে বারাআত ঘোষণা করে?
আসিম বললেন, “না, তারা তাদের কারো সাথে বারাআত ঘোষণা করে না।”

উমার ইবন আবদুল আযীয রহ. বললেন, “আচ্ছা বলো, দীন একটি না দুইটি?
আসিম বললেন, “দীন একটিই।”

উমার ইবন আবদুল আযীয আরও প্রশ্ন করলেন, “এই এক ধর্মে কি তোমাদের জন্য এমন কিছু আছে যা আমার জন্য নেই?”
উত্তরে আসিম বললেন, “না।”

উমার ইবন আবদুল আযীয রহ. বললেন, “তাহলে কী এমন বিপর্যয় এলো যে, তোমার দল হযরত আবু বকর এবং উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা উভয়কে ভালোবাসে এবং তুমিও তাদের উভয়কে ভালোবাসো, অথচ তাদের পদ্ধতিতে স্পষ্ট পার্থক্য ছিল?
বসরাবাসীরা কুফাবাসীকে ভালোবাসলেও তাদের ধরন ও আচার-আচরণে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কুফাবাসী এবং বসরাবাসী উভয়কে কিভাবে ভালবাসতে পারবে, যখন এই দুই দলের জীবন-যাপন পদ্ধতি, আচার-আচরণে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে? সুতরাং তোমাদের কর্মের মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে।
তোমাদের মতে, আমার পরিবারের সাথে বারাআত ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই? পাপীকে লনত দেয়ার পদ্ধতি যদি এমনই হয়, তাহলে খারেজিদের প্রতিনিধি! বলো তো, ফেরাউন ও হামানকে কবে এবং কত দিন অভিশাপ দিয়েছো?”
আসিম বললেন, “জানি না!”

উমর ইবন আবদুল আযীয রহ. বললেন, “এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, ফেরাউনকে অভিশাপ দেওয়ার সময় তোমার নেই, তবুও তুমি দাবি করছো আমি যেন আমার পরিবারকে অভিশাপ দিই বা আমার পূর্বপুরুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আজ তোমরা তা গ্রহণ করছো যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং যা তিনি গ্রহণ করেছিলেন, তা তোমরা প্রত্যাখ্যান করছো।
তিনি আরও বললেন, “এটা কি এমন নয় যে, কিছু লোক মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করেছে, আল্লাহর একত্ববাদ স্বীকার করেছে, নবুওয়াতের সাক্ষ্য দিয়েছে সুতরাং মুসলিম হয়েছে, অথচ তোমরা তাদের হত্যা করছো, তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছো এবং তাদের জান-মাল হালাল মনে করছো? অথচ তোমরা ইয়াহুদী ও অন্যান্য কাফেরদের কোনো ক্ষতি করো না এবং তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করো?

এ শুনে খারিজিদের ইথিওপিয়ান প্রতিনিধি আসিম উত্তর দিলেন, “হে উমার, আমি আজ অবধি আপনার যুক্তির চেয়ে সুস্পষ্ট এবং শক্তিশালী যুক্তি দেখিনি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি সত্যের উপর আছেন এবং আমি নিজেকে সেই দলগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করছি যারা আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে।”

অন্য প্রতিনিধি শাইবানি বলল, “আমি মুসলিমদের (খাওয়ারিজ) সাথে পরামর্শ না করা পর্যন্ত এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি না শোনা পর্যন্ত আমার মতামত প্রকাশ করব না।”
উমার ইবন আবদুল আযীয জবাব দিলেন, “তাহলে তুমি যেভাবে উপযুক্ত মনে করো তা-ই করো!”

পরবর্তীকালে উমার ইবন আবদুল আযীয ইথিওপিয়ান আসিমকে রাষ্ট্রের মধ্যে একটি পদে নিয়োগ দেন। শইবানি অবশ্য খারিজিদের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হয়।

Abu Jundab Abdullah
Exit mobile version