পাকিস্তানি জেনারেলদের ঐতিহাসিক ঔদ্ধত্য ও নির্মম অত্যাচার!

ড. আজমল কাকড়

পাকিস্তানের ইতিহাসে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত, কোনো সরকারই কখনো দায়িত্বশীল ও সুশৃঙ্খল প্রশাসনের পরিচয় দিতে পারেনি। তবে সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থার জেনারেলরা বরাবরই পাকিস্তানের জনগণ ও বেসামরিক সরকারকে বন্দি করে রেখেছে। বিদেশি শক্তির ইশারায় এই জেনারেলরাই এমনসব ঐতিহাসিক নির্যাতন চালিয়েছে, যার ফলভোগ পাকিস্তানের মুসলিম জনগণকে করতে হয়েছে ভয়াবহ ত্যাগ ও ক্ষতির মধ্য দিয়ে, যেসব ক্ষতের রক্ত আজও শুকায়নি।

পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লিয়াকত আলী খান। তাঁর হত্যার পর থেকেই পাকিস্তান সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে সামরিক একনায়কত্ব ও জেনারেলতন্ত্রের অধীনে চলে এসেছে। এমনকি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহও ১৯৪৮ সালে জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের ব্যাপারে বলেছিলেন— “এই আইয়ুব জেনারেল সামরিক দায়িত্বের চেয়ে রাজনৈতিক বিষয়েই বেশি আগ্রহী।”
যেসব জাতি ও নেতৃত্ব ইতিহাসের সত্য এবং জাতির অনুভূতির প্রতি উদাসীন থাকে, তাদের পরিণতি সর্বদাই বিপর্যয়কর হয়।

লিয়াকত আলী খান ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির কোম্পানিবাগে এক জনসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় আফগান সাইয়্যিদ আকবর খানের গুলিতে নিহত হন। বলা হয়ে থাকে, লিয়াকত আলী খান নিজের ভাষণে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে অপমানজনক ও অশালীন কথা বলেন, ফলে আকবর আফগান ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর মাথায় গুলি করেন।

পাকিস্তানি জেনারেলরা দাসত্বপ্রবণ মানসিকতায় গড়ে ওঠা মানুষ, যাদের আত্মনির্ভরতা ও স্বাধীনতার ধারণার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণেই তারা বরাবরই শত্রুপক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজেদের জনগণের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র করেছে। তাদের এই ঔদ্ধত্য ও নিকৃষ্ট রাজনৈতিক ব্যবসায়িক মানসিকতা পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচিত জেনারেল সিকান্দর মির্জার বিষয়ে ঐতিহাসিক নথিতে উল্লেখ আছে— “মির্জা ছিলেন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিশ্বস্ত দালাল মীর জাফরের প্রপৌত্র; সেই মীর জাফরই নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ইংরেজের গুপ্তচরবৃত্তি করে বাংলায় ব্রিটিশ দখলের পথ সুগম করেছিল।”

গুপ্তচরবৃত্তি ও বিশ্বাসঘাতকতার এই কলঙ্কজনক ধারাটি পাকিস্তানি জেনারেলদের ইতিহাসে এক অবিচ্ছিন্ন ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। দুঃখজনক হলো, এই অন্ধকার ছায়া আজও পুরো পাকিস্তানি ইতিহাসের ওপর ছড়িয়ে আছে। তাই পাকিস্তান জাতির দায়িত্ব হলো এই ইতিহাস-বিধ্বংসী জেনারেলদের বিরুদ্ধে নীরব না থাকা; যারা দেশের ইতিহাস, স্বাধীনতা ও মর্যাদা সবকিছু পদদলিত করেছে।

পাকিস্তানি জেনারেলরা শাসননীতিকেও খেলায় পরিণত করেছিল। জেনারেল সিকান্দর মির্জার শাসনামলে মাত্র তিন বছরে (১৯৫৫–১৯৫৮) পাঁচজন প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করা হয়। কারণ, তাঁর কাছে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছিল নিছক এক তামাশা। এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও হালকামি শাসনচর্চার ফলেই পাকিস্তানকে কখনো পূর্ব বাংলায়, কখনো কাশ্মীরে পরাজয় ও অপমানে ডুবে থাকতে হয়েছে।

এই জেনারেলরা শুধু শাসন, জাতি, ভূখণ্ড ও ইতিহাসের প্রতিই অবমাননাকর আচরণ করেনি, বরং দেশের সংবিধান ও আইনের প্রতিও করেছে চরম অন্যায়। বিদেশি শক্তির নির্দেশে তারা এমন এক সংবিধান রচনা করে, যা পাকিস্তানের মুসলিম জনগণের ধর্মীয় ও জাতীয় আত্মার পরিপন্থী এবং বিদেশি প্রভাবসিক্ত ছিল।

ইতিহাস বলছে, আমলাতান্ত্রিক ও পঙ্গু ব্যক্তি মলিক গোলাম মোহাম্মদ জেনারেল আইয়ুব খানের সহযোগিতায় ১৯৫৩ সালে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে বরখাস্ত করে এবং তখন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আলী বোগরাকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে। গোলাম মোহাম্মদ এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে তাঁর কথা একজন মার্কিন সচিব অনুবাদ করে অন্যদের কাছে পৌঁছে দিত। সেই সময়, অর্থাৎ ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান খসড়া প্রণয়ন করা হয়।

এই ঔদ্ধত্য ও ক্ষমতার নেশাই পরবর্তীতে পাকিস্তানকে একবার বাংলাদেশ হারাতে বাধ্য করেছিল, এবং আজও আশঙ্কা দেখা দেয় কাশ্মীর ও বেলুচিস্তানে হয়তো সেই ইতিহাস আবারও পুনরাবৃত্তি হবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল এই জেনারেলদের লজ্জাজনক হস্তক্ষেপের পরিণতি। তারা মুক্ত নির্বাচনকে অস্বীকার করেছিল। ফলে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ছয় দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের দাবিতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। দীর্ঘ যুদ্ধ ও অসংখ্য প্রাণহানির পর পূর্ব পাকিস্তানের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ে, এবং ১৯৪৬ সালে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা সত্যে পরিণত হয়; পাকিস্তানের কৃত্রিম কাঠামো ভেঙে পড়ে, বাংলাদেশ এক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়, আর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইতিহাসের নিকৃষ্টতম পরাজয়ের সম্মুখীন হয়।

পাকিস্তানি জেনারেলরা কেবল নিজেদের জনগণ বা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ওপরই নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলের মুসলিমদের ওপরও অত্যাচার করেছে। এমনকি ফিলিস্তিনিদের মতো নিপীড়িত জাতিও তাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে।

১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রপন্থী জর্ডানের রাজা হুসাইন আশঙ্কা করেছিলেন, ফিলিস্তিনের মুক্তি-আন্দোলন তাঁর সিংহাসনের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে এবং তৎকালীন সিরীয় সরকার (যা সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থক ছিল) ফিলিস্তিনি মুজাহিদদের সহায়তা করতে পারে। রাজা নিজের রাজত্ব রক্ষায় এক ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ নেন—জর্ডান ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায়, যাতে হাজারো নিরীহ মুসলিম শহীদ হয়।

এই অভিযান ইতিহাসে “ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর” নামে কুখ্যাত। এতে জর্ডানকে সহায়তা দেয় ইসরায়েলি গোয়েন্দারা। পাকিস্তান থেকেও এক সামরিক দল পাঠানো হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল হক। এই হত্যাযজ্ঞে ৩৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি শহীদ হন।

এই রক্তপিপাসু কর্মকর্তা পরবর্তীতে পাকিস্তানে ফিরে এসে জেনারেল পদে উন্নীত হন, এবং শেষ পর্যন্ত সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। এরপর তিনি গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে মার্শাল ল’ জারি করেন, এবং নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে মিথ্যা অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেন।

জর্ডানে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ওপর ওই রক্তক্ষয়ী অভিযানের পর জিয়াউল হককে পুরস্কারস্বরূপ জর্ডানের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা প্রদান করা হয়। ইয়াসির আরাফাতের ভাষ্যমতে, সেই অভিযানে ২৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিলেন। ইসরায়েলি জেনারেল মোশে দায়ান মন্তব্য করেছিলেন— “রাজা হুসাইন মাত্র এগারো দিনে যত ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, ইসরায়েল বিশ বছরেও তত হত্যা করতে পারত না।”

পরে, ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করলে, জিয়াউল হকের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানি সামরিক সরকার সেই জিহাদ থেকে বিপুল অর্থনৈতিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক সুবিধা অর্জন করে। তখন “হাজার ক্ষতের মাধ্যমে মৃত্যু”, “কাবুলকে জ্বালিয়ে দাও” এবং “পানি ফুটতে দাও নির্দিষ্ট তাপমাত্রা পর্যন্ত”—এমন নিষ্ঠুর কৌশলগুলো বাস্তবায়িত হয়।

জিয়াউল হক ১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট বাহাওয়ালপুরের আকাশে এক মার্কিন C-130 পরিবহন বিমানের দুর্ঘটনায় নিহত হন। বিমানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত, সামরিক অ্যাটাশে ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় ৩০ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি তখন গিয়েছিলেন আমেরিকান Abrams ট্যাংকের পরিদর্শন দেখতে, যে ট্যাংকগুলো আসলে আন্তর্জাতিকভাবে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ ছিল।

পাকিস্তানি জেনারেলদের ইতিহাস শুরু থেকেই লুটপাট, সহিংসতা, দাসত্ব ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে অবহেলার প্রতীক। তারা ক্ষমতায় এলে জাতির সম্পদ, জনগণের রক্ত-ঘামে অর্জিত অর্থ (বাইতুল মাল) নিজেদের লুণ্ঠনের মাল মনে করে ব্যবহার করে। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, জেনারেল পারভেজ কায়ানি ও পারভেজ মুশাররফের নামেই অস্ট্রেলিয়া ও উপসাগরীয় অঞ্চলে অগণিত সম্পদ ও দ্বীপ রয়েছে; আর পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ ভুগছে দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক সংকটে।

আজ আমরা ভালোভাবেই জানি, কেন পাকিস্তানি জেনারেলরা আফগানিস্তান ও এই কাল্পনিক সীমান্তের (ডুরান্ড লাইন) ওপারে বসবাসকারী জাতিগুলোর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে। তারা আসলে কী দ্বারা প্রভাবিত? রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদের সময় যেসব লোভ ও স্বপ্ন তাদের তাড়িত করেছিল, আজ সেগুলো ধুলিসাৎ হয়েছে। আফগানিস্তানে ফেলে যাওয়া মার্কিন ও ন্যাটো অস্ত্রসামগ্রী পাকিস্তানে পাচার করে মুনাফা লাভের তাদের নতুন স্বপ্নও এখন অধরাই।

পরিশেষে, যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত দার্শনিক জর্জ স্যান্টায়ানার সেই উক্তি স্মরণযোগ্য—
“Those who cannot remember history are doomed to repeat it.”
অর্থ: যারা ইতিহাসকে স্মরণ রাখে না, তারা বাধ্য হয় ইতিহাসকে বারবার পুনরাবৃত্তি করতে।

Exit mobile version