রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর যুদ্ধজীবন: মানবজাতির জন্য শিক্ষা | চতুর্দশ পর্ব

✍🏻 আবু রাইয়ান হামিদী

যখন বিজয়ী মুসলিম বাহিনী মদিনা মুনাওয়ারায় প্রত্যাবর্তন করল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বন্দীদের সঙ্গে কী আচরণ করা হবে, সে বিষয়ে তাঁর নিকটতম সঙ্গীদের সঙ্গে পরামর্শ করেন।

সিদ্দীকে আযম হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিবেদন করলেন—“হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের প্রস্তাব হলো, তাদের নিকট থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হোক। এরা আমাদেরই আত্মীয়-পরিজন। সম্ভবত মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে তাঁদের হৃদয়ে ইসলামের আলো প্রবেশ করবে। আর এর ফলে মুসলিম জাতির আর্থিক অবস্থাও সুদৃঢ় হবে।”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর অভিমত জানতে চাইলেন। তিনি বললেন—“আমার প্রস্তাব হচ্ছে, তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হোক। প্রত্যেক মুসলিমের হাতে তার আত্মীয়-স্বজন বন্দীকে সমর্পণ করা হোক, যাতে সে নিজ হাতে তাদের গর্দান বিনাশ করে দেয়। এভাবে মুশরিকরা উপলব্ধি করবে যে, আমাদের হৃদয়ে তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র মমতা বা সহানুভূতির স্থান নেই।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকরের প্রস্তাব পছন্দ করলেন এবং বন্দীদের মুক্তিপণ গ্রহণের মাধ্যমে মুক্তি দান করলেন। তবে মুক্তিপণ সব বন্দীর উপর আরোপিত ছিল না। যেসব বন্দীর আর্থিক সামর্থ্য ছিল না, তাদের নিঃশর্ত মুক্তি প্রদান করা হয়। আর যারা লেখাপড়া জানতেন, তাদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয় মুসলিম শিশুদের মধ্যে প্রত্যেককে দশজন করে শিক্ষাদান করতে হবে; তাহলেই তারা মুক্তি লাভ করবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় সাহাবী ও পরবর্তীকালে ওহির লেখক হিসেবে প্রসিদ্ধ হযরত যায়েদ ইবন সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহুও এই সময়ে লেখালিখির শিক্ষা লাভ করেন।

হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন—“প্রভাতকালে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে উপস্থিত হলে লক্ষ্য করলাম, তিনি ও হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু উভয়ে অশ্রুবিসর্জন করছেন। জিজ্ঞাসা করলাম—‘হে আল্লাহর রাসূল! কী বিষয় আপনাদেরকে কাঁদাচ্ছে? বলুন, আমিও কাঁদব।’ তিনি উত্তরে বললেন—‘তোমার সহচর আবু বকর যখন মুক্তিপণ গ্রহণের পরামর্শ দিলেন এবং আমি তা মেনে নিলাম, তখন মহান আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করলেন’:

﴿مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَنْ يَكُونَ لَهُ أَسْرَى حَتَّى يُثْخِنَ فِي الْأَرْضِ، تُرِيدُونَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللَّهُ يُرِيدُ الْآخِرَةَ، وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ﴾
(সূরা আল-আনফাল : ৬৭)

অর্থাৎ—“কোনো নবীর জন্য এটি শোভন নয় যে, তিনি বন্দী গ্রহণ করবেন যতক্ষণ না তিনি শত্রুদের রক্তে মাটি রঞ্জিত করেন। তোমরা তো পার্থিব সম্পদ কামনা করছো, অথচ আল্লাহ চান আখিরাত। আল্লাহ সর্বশক্তিমান, প্রজ্ঞাসম্পন্ন।”

যখন বিজয়ী বাহিনী মদিনায় পৌঁছলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বন্দীদের সাহাবাদের মাঝে এই নির্দেশনা সহকারে বণ্টন করলেন:
”استوصوا بالأسارى خيرا“
অর্থাৎ—“বন্দীদের সঙ্গে সদাচরণ করো।”

এটি ছিল এক অভূতপূর্ব নির্দেশনা। সাধারণত বিজয়ী বাহিনী পরাজিতদের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করে; কিন্তু সাহাবারা এই নির্দেশনার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করেন। তাঁরা বন্দীদের নিজেদের চেয়েও উত্তম আহার প্রদান করতেন। প্রথমে তাদের খাওয়াতেন, তারপর যা অবশিষ্ট থাকত, তা নিজেদের ও পরিবারের জন্য রাখতেন। যদি কিছু অবশিষ্ট না থাকত, তবে খেজুর খেয়ে দিনাতিপাত করতেন।

হযরত মুসআব ইবন উমায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহুর ভাই আবদুলআযীয ইবন উমায়ের বর্ণনা করেন—“আমি এক আনসারী সাহাবীর সঙ্গে ছিলাম। তিনি সকালে ও সন্ধ্যায় কিছু রুটি প্রস্তুত করতেন এবং আমাকে দিতেন; নিজে খেজুর খেয়ে থাকতেন। আমি তাঁকে বারবার বলতাম—‘আপনি নিজে খান।’ কিন্তু তিনি বলতেন—‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বন্দীদের প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছেন।’”

এই উদারতা ও আত্মত্যাগই ছিল ইসলামী শাসনের ভিত্তি। রোম ও পারস্যের মতো মহাশক্তিধর সাম্রাজ্যগুলো এই দরিদ্র ও নিঃস্ব সাহাবাদের সামনে টিকতে পারেনি।

বদরের বন্দীদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামাতা আবুল আস ইবন রাবীও ছিলেন, যিনি হযরত যায়নাব রাদিয়াল্লাহু আনহার স্বামী ছিলেন। যখন মুক্তিপণ পাঠানোর সময় এল, হযরত যায়নাব রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁর গলার হার, যা তাঁকে বিবাহের সময় হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা উপহার দিয়েছিলেন, মুক্তিপণ হিসেবে পাঠালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দৃশ্য দেখে অত্যন্ত ব্যথিত হলেন এবং সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করে সেই হার ফিরিয়ে দিলেন এবং আবুল আসকে মুক্তি দিলেন, তবে শর্ত ছিল— তিনি যেন যায়নাব রাদিয়াল্লাহু আনহাকে মদিনায় হিজরত করতে বাধা না দেন। পরবর্তীতে আবুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করেন।

আবুল আস, মুতলিব ইবন হানতাব, সাইফি ইবন আবি রাফিয়া এবং আবু উজ্জা আমর ইবন আবদুল্লাহ— এরা সবাই মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি পান। আবু উজ্জার কেবল কন্যাসন্তান ছিল এবং তিনি দরিদ্র ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে তাঁর দারিদ্র্যের কথা উল্লেখ করলে, তিনি তাঁকে মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি দেন। এরপর থেকে আবু উজ্জা সর্বদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসায় কবিতা রচনা করতেন এবং তাঁর দয়া ও অনুগ্রহের কথা স্মরণ করতেন।

উমায়র ইবন ওহাবের পুত্রও বদরের বন্দীদের মধ্যে ছিলেন। উমায়ের নিজে মদিনায় আসেন, উদ্দেশ্য ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করা। কিন্তু হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর উপর সন্দেহ করেন এবং তাঁকে গ্রেফতার করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে আসেন। তিনি উমায়রের আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বলেন—“আমি আমার পুত্রের মুক্তির জন্য এসেছি।” কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—“তুমি ও সাফওয়ান কা‘বার কাছে বসে কী আলোচনা করেছিলে?” এই প্রশ্ন শুনে উমায়ের ইসলাম গ্রহণ করেন এবং বলেন—“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।”

উমায়ের ও সাফওয়ান কা‘বার কাছে এই ষড়যন্ত্র করেছিলেন। সাফওয়ান উমায়েরের পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং উমায়েরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার উদ্দেশ্যে মদিনায় পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সাফওয়ান জানতেন না যে, উমায়ের অন্ধকার থেকে আলোতে প্রবেশ করবেন।

Exit mobile version