ইসলামের ইতিহাসে খাওয়ারিজদের বিভিন্ন উপাধি ও তাদের বৈশিষ্ট্য
ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে খাওয়ারিজদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে, যা তাদের মতবাদ ও কার্যকলাপের প্রকৃতি প্রতিফলিত করে।
১. الحرورية (আল-হারুরিয়াহ)
এই নাম তাদের দেওয়া হয়েছিল, যারা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর সেনাবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কুফার নিকটবর্তী হারুরা নামক স্থানে একত্র হয়েছিল। ইমাম আবুল হাসান আশআরি রহিমাহুল্লাহ তাঁর মাকালাতুল আশআরি গ্রন্থে লিখেছেন যে, তাদের “আল-হারুরিয়াহ” নামে অভিহিত করা হয়েছিল, কারণ তাদের আন্দোলনের সূচনা হারুরা নামক স্থানে হয়েছিল।
২. الشُّراة (আশ-শুরাত)
খারিজিরা নিজেদের জন্য “আশ-শুরাত” (আত্মবিক্রিতগণ) উপাধি গ্রহণ করেছিল, কেননা তাদের দাবি ছিল, তারা নিজেদের জান-মাল ও অস্তিত্বকে আল্লাহর সন্তুষ্টির বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছে। ইমাম আশআরি রহিমাহুল্লাহ তাঁর মাকালাতুল আশআরি গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন— তাদের এই নামকরণের ভিত্তির পেছনে এই বিশ্বাস ছিল যে, তারা নিজেদের জান্নাতের বিনিময়ে বিক্রয় করে দিয়েছে।
৩. المارقة (আল-মারিক্বাহ)
যখন খাওয়ারিজরা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর সেনাবাহিনী থেকে পৃথক হয়ে বিদ্রোহ করল, তখন তাদের “আল-মারিক্বাহ” নামে আখ্যায়িত করা হয়। শহরিস্তানি রহিমাহুল্লাহ তাঁর আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল গ্রন্থে লিখেছেন যে, তারা ছিল সেই বিদ্রোহী দল, যারা নাহরওয়ান প্রান্তরে একত্র হয়েছিল এবং উগ্র মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর অনমনীয়তা প্রদর্শন করেছিল।
৪. المُحَكِّمة (আল-মুহাক্কিমাহ)
এই উপাধি তাদের দেওয়া হয়েছিল যখন তারা সালিসি (মীমাংসা) ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে ঘোষণা করেছিল— “লা হুকমা ইল্লা লিল্লাহ” (শাসনক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত)। ইমাম আশআরি রহিমাহুল্লাহ তাঁর মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, তাদের এই নামকরণের কারণ ছিল রাজনৈতিক সালিসি ব্যবস্থার প্রত্যাখ্যান এবং উগ্র মতবাদের ওপর কঠোর অনড়তা।
এ সকল উপাধির মধ্যে “আল-মারিক্বাহ” নামে তারা নিজেদের অভিহিত করতে চাইত না, কারণ এর অর্থ “দীন থেকে বিচ্যুত”। ইমাম আবুল হাসান আশআরি রহিমাহুল্লাহ লিখেছেন যে, তারা এই নামকে নিজেদের জন্য অপমানজনক মনে করত এবং কখনোই তারা এটিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেনি।
—
খারিজি মতবাদের উৎপত্তি ও বিস্তার
খারিজি মতবাদের উৎপত্তি নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছে।
১. প্রথম মত
কিছু গবেষক মনে করেন, খাওয়ারিজদের আদি প্রবক্তা ছিল যুল-খুওয়াইসিরাহ বা আব্দুল্লাহ ইবন যুল-খুওয়াইসিরাহ আত-তামিমি। সে গনিমতের বণ্টন সংক্রান্ত বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ন্যায়বিচার ও আদর্শিক ভারসাম্যের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল।
ইমাম বুখারি রহিমাহুল্লাহ তাঁর সহিহ বুখারি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন—
একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গনিমতের সম্পদ বণ্টন করছিলেন। তখন যুল-খুওয়াইসিরাহ বলে উঠল:
“হে আল্লাহর রাসূল, ইনসাফ করুন!”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:
“যদি আমি ন্যায়বিচার না করি, তবে আর কে করবে?”
তখন হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে হত্যা করতে চাইলেন, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:
“তাকে ছেড়ে দাও। কারণ, তার বংশধরদের মধ্য থেকে এমন একদল আত্মপ্রকাশ করবে, যাদের নামায ও রোযা দেখে তোমরা নিজেদের ইবাদতকে তুচ্ছ মনে করবে, কিন্তু তারা দীন থেকে এমনভাবে বিচ্যুত হবে, যেমন তীর শিকার বিদ্ধ করে দ্রুত বেরিয়ে যায়।”
এই হাদিসের আলোকে কিছু গবেষক মনে করেন, যুল-খুওয়াইসিরাহ ছিলেন খারিজি মতবাদের প্রথম অনুগামী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে হত্যা করতে নিষেধ করেছিলেন, যেন মানুষ ধারণা না করে যে, তিনি কেবলমাত্র তাঁর বিরোধীদের নির্মূল করেন।
—
২. দ্বিতীয় মত
কাজী আলী ইবনু আবিল ইয্ আল-হানাফি আদ-দিমাশকী রহিমাহুল্লাহ তাঁর শরহুল আকিদাতিত ত্বাহাওয়িয়্যাহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, খারিজিরা প্রথম আত্মপ্রকাশ করে সেই ভয়াবহ ফিতনার সময়, যে ফিতনা হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয় এবং তাঁর শাহাদাতের মাধ্যমে চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।
—
৩. তৃতীয় মত
অনেক ঐতিহাসিকের মতে, খারিজিদের প্রকৃত উত্থান ঘটে তখন, যখন তারা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাহিনী থেকে পৃথক হয়ে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে। এই মত অধিক প্রচলিত এবং ইতিহাসবিদদের মধ্যে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য।
ইমাম আশআরি রহিমাহুল্লাহ খারিজিদের ইতিহাস সম্পর্কে বলেন—
“তাদের খারিজি বলা হয়, কারণ তারা হযরত আলী ইবনু আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল।”
এরপর থেকে “খারিজি” উপাধিটি এমনভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে যে, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘটনা ব্যতীত এই নামের প্রকৃত তাৎপর্য বাকি থাকে না।