লাল মসজিদ— নিপীড়ন ও দমন-পীড়নের অন্ধকার ইতিহাস এবং অবিরাম প্রতিরোধের সংগ্রাম

✍🏻 নূরুল হুদা খলিল

আমার কলম যেন এই শব্দমালার ভার বহনে অপারগ, তবু আমি লিখছি— কারণ ইতিহাস কখনো চাপা পড়ে থাকে না।

ঈমানের দুর্গ ভাঙার নেপথ্য কাহিনি – ইসলামাবাদের চেতনায় এক অপমানের দাগ

২০০৭ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইসলামাবাদের কেন্দ্রে অবস্থিত লাল মসজিদের নিরপরাধ ছাত্র-ছাত্রী, হাফেয-হাফেযা ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ওপর নির্মম হামলা চালায়। এই আগ্রাসন কেবল পাকিস্তানি কোনো সেনাপতির একক সিদ্ধান্ত ছিল না; বরং এটি ছিল আমেরিকা, ইসরাইল ও ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার লক্ষ্য ছিল ইসলামী চেতনার উচ্ছেদ।

লাল মসজিদ কোনো সাধারণ ইসলামী উপাসনালয় ছিল না; বরং এটি ছিল ইসলামী জাগরণের এক জীবন্ত প্রতীক। সেখানে এমন সাহসী-সজ্জন পুরুষ ও সতী-সাধ্বী পর্দানশীন নারীরা অধ্যয়ন করতেন, যারা ইসলামের সুমহান আদর্শের প্রতি অবিচল ছিলেন এবং তখনকার স্বৈরশাসনের ইসলামবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সত্যের সেই বজ্রধ্বনি তাদের কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে, যারা ইসলামী আদর্শের চিরন্তন শত্রু।

জুলুম ও নৃশংসতার এক কালো অধ্যায় এবং নিষ্পাপদের রক্তের অক্ষয় সাক্ষ্য

২০০৭ সালের জুলাই মাসে মার্কিন নির্দেশনায় এবং তৎকালীন শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের আদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী লাল মসজিদের নিরীহ ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং কুরআনের হাফেয-হাফেযাদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায়। এই অভিযানের জন্য মোতায়েন করা হয় দশ হাজারেরও বেশি সেনা, ব্যবহৃত হয় ভারী অস্ত্রশস্ত্র, ট্যাংক, হেলিকপ্টার এবং এমনকি বিষাক্ত গ্যাস ও রাসায়নিক বোমা— যা মূলত সামরিক যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ীএক হাজারের বেশি নারী-শিক্ষার্থী, ছাত্র, আলেম ও হাফেয শহীদ হন। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে এই সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে যায়। শহীদদের লাশ পর্যন্ত সম্মান পায়নি; সেনারা তাদের দেহ পুড়িয়ে ফেলে যেন জুলুমের সাক্ষ্যপ্রমাণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

তবে সবচেয়ে মর্মন্তুদ অধ্যায় হলো প্রায় দুই শতাধিক সংব্রত, পর্দানশীল মুমিনা ছাত্রীকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী এসকল ছাত্রীদের মার্কিন বাহিনীর হাতে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তুলে দেওয়া হয় এবং তাদের বাগরাম, গুয়ান্তানামো ও অন্যান্য গোপন মার্কিন কারাগারে প্রেরণ করা হয়।

আমেরিকা, ইসরাইল ও ভারতের এক অশুভ আঁতাত

আমেরিকার গুপ্ত হাত

অভিযানের সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত অ্যান প্যাটারসন পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখছিল। এমনকি এই অভিযানের সময় মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিল। সিআইএ এই হামলার জন্য পাঁচশ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করেছিল, যার বিনিময়ে অভিযানের নেতৃত্বদানকারী সামরিক কর্মকর্তারা পরবর্তী সময়ে আমেরিকায় স্থায়ী ভিসা ও বিলাসবহুল সম্পত্তি অর্জন করেন।

ইসরাইলি সহযোগিতা

অভিযানের সময় পাকিস্তান ব্যবহার করে ইসরাইলের সরবরাহকৃত উন্নত অস্ত্রশস্ত্র, যেমন লেজার বোমা ও বিষাক্ত গ্যাস, যা এমনভাবে কাজ করে যেন শহীদদের দেহ অবশিষ্ট না থাকে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কিছু দেশপ্রেমিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এই হামলাকে মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু তাদের হয় হত্যা করা হয়, নয়তো চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়।

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর অগ্নি-উস্কানি

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (RAW) পাকিস্তানের শাসকদের কাছে ভুয়া গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছিল, যাতে লাল মসজিদকে ‘আল কায়েদার ঘাঁটি’ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। পাকিস্তানি সামরিক ও গোয়েন্দা মহলে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ভারতীয় এজেন্টরা এই অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও কৌশলগত সহায়তা জুগিয়েছিল।

অভিযানের পর, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা পাকিস্তানের কিছু গণমাধ্যমকে ১৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়, যাতে তারা এই হামলাকে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এক সাফল্য’ হিসেবে প্রচার করতে পারে।

সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে প্রতিরোধ ও তা নৃশংসভাবে দমন

অভিযানের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কিছু বিবেকবান কর্মকর্তা লাল মসজিদের ওপর হামলার ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই এই হামলাকে ‘অনৈতিক ও ইসলামবিরোধী’ বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু এদের মধ্যে কেউ সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত হন, কেউ আবার রহস্যজনক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

কর্নেল আব্বাস:

তিনি লাল মসজিদের বিরুদ্ধে অভিযানের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। ফলাফল – তাঁকে গোপনে হত্যা করা হয়।

মেজর আমির:

তিনি পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার অন্যতম কর্মকর্তা ছিলেন এবং লাল মসজিদ অভিযানের প্রকৃত সত্য উন্মোচন করতে চেয়েছিলেন। অজ্ঞাত চাপের কারণে তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।

ব্রিগেডিয়ার আলী খান:

তিনি এই হামলার প্রতিবাদ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তাঁকে ‘সন্ত্রাসবাদের’ মিথ্যা অভিযোগে কারারুদ্ধ করা হয়।

পাকিস্তানের দ্বিমুখী নীতি – ব্যর্থতার দায় অন্যের ওপর চাপানো

যদি লাল মসজিদ ‘সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটি’ হতো, তবে সেখানে কেন শুধুমাত্র কুরআন, হাদিস ও ইসলামী জ্ঞানচর্চা চলত? যদি এই অভিযানের উদ্দেশ্য সত্যিই ‘সন্ত্রাসবাদের নির্মূল’ হতো, তবে নিষ্পাপ ছাত্রীদের কেন মার্কিন বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হলো?

কেন এই অভিযানের পর সংশ্লিষ্ট সামরিক কর্মকর্তারা আমেরিকার কাছ থেকে বিলাসবহুল ভিসা ও সম্পত্তি লাভ করল?

পাকিস্তানের বরং তার ব্যর্থ, অনৈতিক ও ইসলামবিরোধী নীতিগুলো সংশোধন করা উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে সে তার ব্যর্থতা ঢাকতে, জনগণের দৃষ্টি সরাতে বারবার অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে যাচ্ছে।

লাল মসজিদের ইতিহাস – মুছে ফেলা অসম্ভব

লাল মসজিদে প্রবাহিত রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি, অথচ ইতিহাসের এই কালো অধ্যায় পুনরায় রচিত হচ্ছে। জামিয়া হাফসার মহীয়সী নেত্রী উম্মে হাসানকে গ্রেফতার করা হলো, নিষ্পাপ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর আবারো নিপীড়নের হাত বাড়ানো হলো।

কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে! এই রক্ত, এই ত্যাগ, এই প্রতিরোধ ইতিহাসের পরতে পরতে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে। আর ইতিহাস কখনো চাপা দেওয়া যায় না।

Exit mobile version