আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানো নেতা

✍🏻 আহমাদ আরমাগান

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কবল থেকে মুক্তির পর আফগান জনগণের চিন্তা ও প্রত্যাশা ছিল— এবার বিজয় উল্লাস হবে, দেশে শান্তি, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির সুবাতাস বইবে, উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের যাত্রা শুরু হবে এবং এক সর্বসম্মত মুসলিম সরকার আফগানিস্তানকে বিশ্বমঞ্চে গৌরবের সঙ্গে তুলে ধরবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এ সবই রয়ে গেল স্বপ্ন আর কল্পনার অতল গহ্বরে।

জিহাদি সংগঠনসমূহ বহিরাগত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ইন্ধন ও সহায়তায়, ক্ষমতার নেশায় এমন এক গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত করল, যা আফগানিস্তানের অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলিকে রুশ বাহিনীর ক্ষতির চেয়েও গভীরভাবে ক্ষতবিক্ষত করল। এর পাশাপাশি ভাষাগত, আঞ্চলিক ও বর্ণগত বিদ্বেষের এমন বীজ বপন করা হলো, যা পূর্বে কখনো দেখা যায়নি।

সোভিয়েত-বিরোধী সংগ্রামে অর্জিত জিহাদি ঐতিহ্য ও জাতীয় মর্যাদা সংরক্ষণের প্রচেষ্টা যেন জলে ভেসে গেল। মুজাহিদ নেতারা এমন রাজনৈতিক চুক্তি, লেনদেন ও জাতীয়তাবাদে নিমগ্ন হয়ে পড়লেন যে, আজও কাবুল ধ্বংসের পূর্ণ ক্ষতিপূরণ তোলা সম্ভব হয়নি।

যদিও এই ধ্বংসযজ্ঞ ও গৃহযুদ্ধের অবসান এবং সংগঠনপ্রধানদের ক্ষমতালিপ্সা থেকে জাতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল, কিন্তু তা বারংবার ব্যর্থ হচ্ছিল; কারণ সংলাপ ও অস্ত্র কখনো সহাবস্থান করতে পারেনি। সংগঠন নেতারা নিজেদের জনবল ও শক্তির অহংকারে বিশ্বনায়ক মনে করতেন, অথচ তাদের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা, ধন-সম্পদ ও শাসনভার ছিনিয়ে নেওয়া।

এ সময়েই আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহে ও কিছু আল্লাহপ্রেমিকের দোয়ার ফলস্বরূপ আফগান জাতিকে এক দরবেশরূপী মুক্তিদাতা দান করা হয়েছিল; যিনি দৃঢ় সংকল্প, অসীম সাহস ও নিষ্ঠাবান সাথীদের ভরসায় অস্ত্রের শক্তিতে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটান।

এই দরবেশপ্রকৃতির নেতা ছিলেন মরহুম মোল্লা মুহাম্মাদ উমার মুজাহিদ রহিমাহুল্লাহ। তিনি সেই মহাপুরুষ, যিনি রুশবিরোধী জিহাদে অংশগ্রহণ ও সংগ্রামের গৌরব অর্জন করেছিলেন। তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না, যারা জিহাদের পরে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল; বরং পরিস্থিতির গভীর বিশ্লেষণের পর তিনি ‘তালেবান ইসলামী আন্দোলন’-এর ভিত্তি স্থাপন করেন এবং অতি অল্প সময়ে কান্দাহার থেকে কাবুল পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ ও যুদ্ধবাজদের অবসান ঘটান।

আফগান জাতি, যারা দীর্ঘদিন ধরে রক্তাক্ত সংঘাত ও বঞ্চনার বোঝা বহন করছিল, তাঁকে ও তাঁর সহযোদ্ধাদের ‘ত্রাণকর্তা ফেরেশতা’ রূপে বরণ করে নেয়। এবং প্রকৃতপক্ষে, তিনি ছিলেন সেই মুক্তিদাতা, যিনি কলঙ্কিত ইতিহাসের পাতায় মুক্তির এক উজ্জ্বল অধ্যায় সংযোজন করেছিলেন।

অনেক আন্তর্জাতিক ইতিহাসবিদ ও গবেষক আজও বিস্মিত হন— কীভাবে এক মাদরাসাশিক্ষক ও ইমাম গৃহযুদ্ধ নিরসনের তত্ত্ব প্রস্তাব করেন এবং অতীব সীমিত সম্পদে তা বাস্তবে রূপদান করেন! যখন বহিরাগত গোয়েন্দা সংস্থাগুলি ও যুদ্ধের ঠিকাদাররা দেখতে পেল তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি লুপ্ত হচ্ছে, তারা এই মুক্তিদাতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারের জাল বিছিয়ে দিল; কিন্তু মোল্লা সাহেব তো সেই শাহীন (বাজ) ছিলেন না, যে শিকারির জালে আটকাবে।

শুধুমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে এবং তাঁর সৎ ও প্রকৃত মুজাহিদ সঙ্গীদের সহায়তায়, তিনি কাবুলের দখলদার লুটেরা, জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনকারী ও বিদেশি এজেন্টদের নির্মূল করেন। তিনি জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, স্বাধীনতা অর্জন সহজ, কিন্তু তা রক্ষা করা দুষ্কর। তিনি ঘোষণা করেন, “তোমরা জিহাদ ও শহীদদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো, তাই আজ দুনিয়াতেই তার শাস্তি ভোগ করছো, আর আখিরাতে তো কঠিন হিসাব অপেক্ষা করছে।”

মরহুম মোল্লা সাহেবের সংগ্রাম ও বিজয়ের বহু গোপন রহস্য রয়েছে, যাদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হলো–

১. ঈমানি দৃঢ়তা ও আদর্শ:
প্রত্যেক সফল সংগ্রামের মূল ভিত্তি দৃঢ় আদর্শ ও অটল সংকল্প। মোল্লা সাহেব ও ইসলামী ইমারাতের মূলনীতি ছিল বিশুদ্ধ ইসলামের প্রতিনিধিত্ব, অশান্তি ও অপশক্তির মূল উৎপাটন এবং আফগান জাতিকে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রদান।
তিনি নিজের ঈমানি চিন্তাধারার উপর আস্থা রেখেছিলেন, সহমনা সাথীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন এবং অটল সংকল্পের ফলে বিজয় অর্জন করেছিলেন। তাঁর আদর্শ ছিল সংশয়হীন ও স্পষ্ট, যার জন্য তিনি জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল— তিনি বিশ্বাস করতেন, কেবল মসজিদ ও মাদরাসার বারান্দা আবদ্ধ থাকলে চলবে না; অস্ত্র হাতে নিয়ে সংগ্রাম করতে হবে, শাসন ও রাষ্ট্র পরিচালনার কলাকৌশল জানতে হবে, অন্যথায় যুগের চাহিদা ও ইসলামবিদ্বেষী ষড়যন্ত্রের জবাব কেবল নসিহত দিয়ে সম্ভব নয়। তিনি কঠিনতম সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন এবং শাসন ব্যবস্থাকে ইসলামী রঙে রাঙিয়ে ছিলেন।

২. গণভিত্তি ও জনপ্রিয়তা:
মোল্লা সাহেব আন্দোলন প্রতিষ্ঠার পূর্বেও জনগণের মধ্যে একজন সৎ, প্রভাবশালী ও আলিম হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি নিজের জিহাদি অতীত ও ব্যক্তিত্বকে ধন, ক্ষমতা বা প্রতিশ্রুতির বদলে বিকিয়ে দেননি; তাই তিনি সবত্রই জনগণের আস্থার প্রতীক ছিলেন।
আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন জাতীয় প্রয়োজনে, সাথীদের ও জনগণের পরামর্শ নিয়ে। তাঁর সত্যনিষ্ঠা এমন ছিল যে, মানুষ জান-মাল দিয়ে তাঁকে সমর্থন করেছিল এবং অবশেষে তারাই বিজয়ী হয়েছিল, অর্থাৎ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল।

৩. ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের অনন্য দৃষ্টান্ত:
সাবেক ইমারাতের শেষ দিন পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম অব্যাহত ছিল। শহীদ ও আহতরা প্রতিনিয়ত আসত; অপরদিকে অশুভ শক্তিগুলো বিদেশি প্রভুদের সহায়তায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। তবুও, ইসলামী ইমারাত পাঞ্জশির ছাড়া সমগ্র আফগানিস্তানে শান্তি ও ইসলামের পতাকা উড্ডীন করে।
এই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়— কোনো সংগ্রাম ত্যাগ ও ক্ষত ব্যতিরেকে সফল হয় না।

৪. ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উম্মাহকে প্রাধান্য দেয়া:
মোল্লা সাহেবের সংগ্রামে প্রথমবারের মতো একটি জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন আকৃতি পায়। তিনি আহমাদ শাহ আবদালির সেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেন— আফগানিস্তান সকল আফগানের ঘর, আর তার ভৌগোলিক সীমান্ত রক্ষা করা প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থের পরিবর্তে জাতীয় মঙ্গলকে অগ্রাধিকার দিতেন, যা আজও ইসলামী ইমারাতের জন্য জাতীয় পাঠের মর্যাদা বহন করে।

৫. স্বাধীনতা ও পরনির্ভরতাহীনতা:
এর আগে ধারণা ছিল, কোনও চিন্তাধারা বা সামরিক আন্দোলন যদি বাহ্যিক সমর্থন ছাড়া হয়, তবে তা সফল হতে পারে না। কিন্তু মোল্লা সাহেব প্রমাণ করেন, যদি কোনো আন্দোলন জনগণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, আল্লাহর উপর ভরসা ও নিজের সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে, তবে সাফল্য বিলম্বিত হলেও চিরস্থায়ী হয়।
এ কারণেই আজ তিন দশক পরও ইসলামী ইমারাতের পতাকা উড্ডীন, এবং মোল্লা সাহেবের শাহাদাতের পরও তাঁর আদর্শ পুনরুজ্জীবিত হয়েছে, এমনকি আজও সেই আদর্শ কাবুলের রাষ্ট্রপ্রাসাদে পতপত করে উড়ছে।

সমগ্র বিবেচনায় বলা যায়, যদি ইসলামী ইমারাতের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মুহাম্মাদ উমার মুজাহিদ রহিমাহুল্লাহর ত্যাগ ও মুক্তির পাঠ আমাদের সামনে না থাকত, এবং তাঁর সৎ সহচরগণ আত্মোৎসর্গ করে ময়দানে অবতীর্ণ না হতেন, তবে আজও আফগানিস্তান গৃহযুদ্ধের আগুনে দগ্ধ হতো এবং বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার খেলনারূপে ব্যবহৃত হতো।

কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, আজ আফগানিস্তান বিশ্বের শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রগুলির অন্যতম, নিজস্ব জাতীয় সম্পদ দ্বারা পরিচালিত এবং কারো কাছে ঋণগ্রস্ত নয়। এই সমস্ত কিছুই সেই মহান নেতা মোল্লা মুহাম্মাদ উমার মুজাহিদের নেতৃত্ব ও বরকতের ফসল।

আল্লাহ তা‘আলা মোল্লা সাহেব রহিমাহুল্লাহকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন এবং ইসলামী ইমারাতের বর্তমান নেতাদের তাঁর আদর্শে দৃঢ়তার সাথে অটল থাকার তাওফিক দিন।

Exit mobile version