রাসূলুল্লাহ (ﷺ)–এর বরকতময় জন্মের সময় পৃথিবীর অবস্থা!

হাসসান মুজাহিদ

#image_title

ইসলাম-পূর্ব আরব অঞ্চলে নানান উদ্ভট ধর্মের রাজত্ব ছিল। ছিল বহু ভ্রান্ত ধারণা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বাস করতো— পৃথিবীর সমস্ত পরিবর্তন সময়ের প্রবর্তন বা প্রাকৃতিক চক্রের কারণে ঘটেছে; আল্লাহর কোনো অস্তিত্ব নেই। (আল ইয়াযু বিল্লাহ)।

কিছু আরব মূর্তি পূজা করতো এই যুক্তিতে যে, এই মূর্তিগুলো আল্লাহর কাছে তাদের জন্য উৎস বা মাধ্যম হবে। তায়েফের ‘সাক্বিফ গোত্র’ লাত নামক একটি মূর্তির পূজা করতো, কুরাইশরা মক্কায় উযযা নামক একটি মূর্তির পূজা করতো এবং ‘আওস’ ও ‘খাযরাজ’ গোত্র মদীনায় মানাত নামক একটি মূর্তি পূজার করতো।

মূর্তির নামে মানুষদের বলি দেওয়া হতো, পিতার মৃত্যুর পরে তার স্ত্রীদেরকে পুত্ররা উত্তরাধিকারসূত্রে পেতো, আপন বোনদের বিয়ে করা হতো, নারীদের জন্য মোহর নির্ধারিত ছিল না, ব্যভিচার ও মদ ছিল সাধারণ বিষয়। তৎকালীন আরবের সবচেয়ে বিখ্যাত কবি ও রাজপুত্র ইমরাউল কায়েস তার কবিতায় নিজ চাচাতো বোনের সাথে করা ব্যভিচারের গল্প গর্বভরে বর্ণনা করে কাবার দরজায় টাঙিয়ে দিয়েছিল। অনৈতিকতা ও অশ্লীলতা কেমন ছিল তা এই ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়।

যাদুবিদ্যার ব্যাপক প্রচলন ছিল। এটা শেখার জন্য অনেকেই শয়তানের সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করতো।

কুসংস্কার:
আরবরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক কিছুকে অশুভ মনে করতো। কাককে বিচ্ছেদের কারণ মনে করতো, বোবা ব্যক্তির আওয়াজকে মৃত্যু ও ধ্বংস বলে ব্যাখ্যা করতো এবং তাকে অপয়া বলে মনে করতো।

গৃহযুদ্ধ এবং শত্রুতা:
জাহিলিয়াতের যুগে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মারামারি শুরু হতো এবং বছরের পর বছর শত শত লোক তা নিয়ে মারামারি করতো। এসব যুদ্ধের কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণে যুদ্ধগুলি শুরু হয়নি। যুদ্ধে দক্ষ ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করা হতো, যুদ্ধের সরঞ্জামকে গুরুত্ব দেওয়া হতো, যেকারণে আজও আরবী ভাষায় ঘোড়া ও তরবারির শত শত নাম রয়েছে।

প্রেম এবং অবৈধ সম্পর্ক:
জাহিলিয়াতের যুগে পুরুষদের সামনে নারীদের কোনো ধরনের পর্দা ছিল না। একারণেই তাদের মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠতো। যে ব্যক্তি কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতো না তাকে খারাপ বলে গণ্য করা হতো। প্রেমকে গর্বিত অর্জন হিসাবে বিবেচনা করা হতো। এমনকি কিছু গোত্র প্রেমের জন্য বিখ্যাত ছিল, যেমন বনী ইযরা।

কন্যাদের জীবন্ত কবর দেওয়া:
কুরাইশ ও বনু তামিম গোত্রের মধ্যে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া একটি সাধারণ রীতি ছিল। এসব গোত্রের লোকেরা একে গর্বের বিষয় মনে করতো। এব্যাপারে তারা এতটাই উৎসুক ছিল যে, মেয়ের বয়স পাঁচ-ছয় বছর হলেই তাকে পরিষ্কার পোশাক পরিয়ে কোনো না কোনো অজুহাতে বাড়ি থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হতো। নিষ্ঠুর বাবা আগ থেকেই একটি গভীর গর্ত খুঁড়ে রাখতো, অতঃপর নিজের মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে সেই গর্তে ফেলে দিতো। নিষ্পাপ কন্যা তার পিতার কাছে শত আকুতি করলেও নির্দয় বাবা তার মেয়েকে মাটিচাপা দিয়ে বাড়িতে ফিরে আসতো। এই নিষ্ঠুরতা আরবের কিছু গোত্রে বেশি ছিল এবং অন্যদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম ছিল। বনু তামিমের এক লোক কায়েস বিন আসিম, তার দশ কন্যাকে নিজ হাতে জীবন্ত কবর দিয়েছিল।

চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই:
প্রাক ইসলামী যুগে শহুরে লোকরা নিজ প্রতিবেশীদের অধিকার সম্পর্কে যত্নশীল থাকলেও অন্যদিকে তাদের মধ্যে প্রতারণা ছিল অতিমাত্রায়। যারা যাযাবর ছিল তারা লুটপাট ও চুরির জন্য বিখ্যাত ছিল। পথে কোনো একাকী পথিককে দেখলে তারা সে পথিকের সাথে যা কিছু থাকতো তা কেড়ে নিয়ে তাকে ক্রীতদাস বানিয়ে অন্যের কাছে বিক্রি করে দিতো। তারা মরুভূমিতে পানির কূপগুলো ঘাস দিয়ে ঢেকে রাখতো যাতে পথিক পানির পিপাসায় মারা যায় আর তার মালামাল তাদের হাতে চলে যায়। কিছু লোক তো চুরি এবং অমানবিক নির্যাতনে এতটাই বিখ্যাত এবং পারদর্শী ছিল যে, তাদের নাম দেয়া হয়েছিল ‘যুবানুল আরব’ (আরবের নেকড়ে)।

­জাহিলি যুগের আচার ও প্রথা:
কেউ মারা গেলে সেই ব্যক্তির কবরে তার উট বেঁধে রাখা হতো। কাপড় দিয়ে উটটির চোখ ঢেকে রেখে উটটিকে ওই যন্ত্রণাদায়ক অবস্থায় ছেড়ে চলে আসতো, এমনকি উটটিও মারা যেত। “মৃত ব্যক্তি জীবিত হলে এই উটে চড়ে ফিরে আসবে”— বিশ্বাস থেকে তারা এটি করে থাকতো।

এটাও তাদের বিশ্বাস ছিল যে, কোনো ব্যক্তি যখন কোনো শহরে প্রবেশ করতো এবং সেখানে কোনো রোগের আশংকা থাকতো, তখন সে শহরের গেটে দাঁড়ায়ে রোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য গাধার মতো চেচামেচি করতো।

যখন কারো উটের সংখ্যা এক হাজারে পৌঁছতো, তখন সে একটি উটের চোখ উপড়ে ফেলে সেটাকে একা রেখে দিতো যাতে অন্য উটগুলো বদনজর থেকে রক্ষা পায়।

যখন একটি উট খোস-পাঁচড়ায় আক্রান্ত হতো, তখন রোগাক্রান্ত উটটির পরিবর্তে একটি সুস্থ উটকে চিকিৎসা করা হতো। কারণ তারা বিশ্বাস করতো যে, একটি সুস্থ উট একটি অসুস্থ উটকে আরোগ্য দিতে পারে।

যখন কোনো একটি ষাঁড় পানি পান না করতো, তখন সকল ষাঁড়কে হত্যা করা হতো কারণ তারা বিশ্বাস করতো, জিনেরা এই ষাঁড়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করছে বিধায় তাদের পানি পান করতে বাধা দিচ্ছে।

তাদের মধ্যে থেকে যখন কেউ সফরে বের হতো, তখন “আরতাম” নামক একটি পাতলা কাঠের টুকরোয় গিঁট বেঁধে বের হতো। অতঃপর সে যখন সফর থেকে ফিরে আসতো, তখন সে দেখতো গিঁটটি এখনও অক্ষত রয়ে গেছে কি না, যদি গিঁট গিঁটের জায়গায় থাকতো, এর অর্থ ছিল তার অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী কারো সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়ায়নি। আর যদি গিঁটটি খুলে যেত, তাহলে সে বিশ্বাস করতো তার স্ত্রী কারো সাথে ব্যভিচার করেছে।

তীর রাখার পাত্রে তিনটি তীর রাখা হতো। একটিতে “না”, দ্বিতীয়টিতে “হ্যাঁ” এবং তৃতীয়টিতে কিছুই লিখা থাকতো না। তারা কোনো কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলে পাত্রে হাত ঢুকিয়ে তীর বের করতো। যদি “হ্যাঁ” লিখা তীর বের হতো, তবে তারা কাজটি করতো। যদি “না” লিখা তীর বের হতো, তবে তারা সেই কাজ করা থেকে বিরত থাকতো। যদি তৃতীয় তীরটি বের হতো, যেটিতে কিছুই লিখা নেই, তবে আবারও পাত্রে হাত ঢুকাতো।

তাদের এই বিশ্বাসও ছিল যে, কারো হাতে খুন হওয়া ব্যক্তির মৃত্যুর প্রতিশোধ না নিলে সেই ব্যক্তির মাথার খুলি থেকে ‘হামা’ নামক পাখি বেরিয়ে আসবে এবং প্রতিশোধ নেয়ার আগ পর্যন্ত পাখিটি শব্দ করে করে বলবে, “আমি তৃষ্ণার্ত! আমি তৃষ্ণার্ত!”।

তারা আরও বিশ্বাস করতো যে, প্রত্যেক ব্যক্তির পেটে একটি সাপ থাকে, যেটি সে ব্যক্তি ক্ষুধার্ত হলে তার পাঁজর খেতে শুরু করে।

এটাও তাদের বিশ্বাস ছিল যে, কোনো মহিলার সন্তান হয়ে মারা গেলে মৃত ব্যক্তির শরীরের উপর লাফালে-ঝাঁপালে আর তার সন্তান হয়ে মারা যাবে না।

মানুষ যখন জাহেলিয়াতের এমন সর্বনিম্ন স্তরে ছিল, প্রতিটি ফিতনা-ফাসাদের বাজার সরগরম ছিল; এমন পরিস্থিতিতে যুগ এমন এক ব্যক্তিত্বের অপেক্ষায় ছিল যার আগমনের জন্য শতশত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে বিশ্বকে।

এমনকি আকাশের তারাও সেই দিনের জন্য অনন্ত অনাদিকাল থেকে পথ চেয়ে ছিল। আকাশটাও সেই সকালের আলোর আশায় দিনরাত ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্ছিল বছরের পর বছর।

ফেরেশতাদের মুবারকময় মজলিস, বৈচিত্র্যময় মহাবিশ্বের রঙ, চাঁদ ও সূর্যের রশ্মি, মেঘ এবং বাতাসের সঞ্চালন ও গতিবিধি, ইবরাহীম আলাইহিসসালামের তাওহিদ, ইউসুফ আলাইহিসসালামের সৌন্দর্য, মূসা আলাইহিসসালামের মুজিযা, ঈসা আলাইহিসসালামের মুজিযাময় আরোগ্যদান— এসবকিছুই যেন ছিল দো-জাহানের সরদার মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতের উদ্দেশ্যে।

হ্যাঁ! যেদিন পারস্য সম্রাট কিসরার প্রাসাদ কেঁপে উঠেছিল। পারস্যের অগ্নি উপাসনালয়ের আগুন নিভে গিয়েছিল, অথচ যে আগুন এক হাজার বছর পর্যন্ত প্রজ্বলিত ছিল। মহাবিশ্বের মহিমা। রোমানদের আতঙ্ক। যেদিন চীনের প্রাসাদ ধসে পড়েছিল। যেদিন থেকে গোমরাহীর অন্ধকার ম্লান হতে শুরু করেছিল। যেদিন মূর্তিগুলো থেকে ধুলো উড়েছিল। যেদিন বিশ্বের সবগুলো মূর্তি মাটির দিকে নত হয়ে পড়েছিল। যেদিন জাদুকরদের কোলাহল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যেদিন খ্রিস্টধর্মের শরতের পাতা শুকিয়ে গিয়েছিল। শিরক ও কুসংস্কারের মেঘ দূর হয়ে তাওহিদের স্লোগানে মুখরিত হয়ে পড়েছিল বিশ্ব যেদিন। যেদিন হিদায়েতের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। যেদিন মানবতার দর্পণে ফুটে উঠেছিল নবুওয়াতের পবিত্র আলো অর্থাৎ আবদুল্লাহর ইয়াতিম, আমিনার কলিজার টুকরো, হারামের বাদশাহ, আরবের শাসক সেদিন সোমবার রবিউল আউয়ালের নবম বা দ্বাদশ তারিখে পৃথিবীতে আগমন করেন।

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন ছিল সমগ্র মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক মহান রহমত এবং সমস্ত অনিয়ম ও দুর্নীতির অবসানের প্রতিশ্রুতি। এই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা আমাদের সকলের জন্য ফরয, তবে শুকরিয়া আদায়ের উপায় কেবল শুধু মিলাদুন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপলক্ষে জশনে জুলুস আর দান-খয়রাত করা নয় বরং পদ্ধতি হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ অনুসরণ করা। তাঁর আনিত দীন, যে দীন আজ সারাবিশ্বে মাযলুম ও অপরিচিত, যে দীনে চারদিক থেকে হামলা হচ্ছে, সে দীনের খিদমত করা। এটিকে রক্ষা করা এবং পুনরুজ্জীবিত করা। জাহিলিয়াতের যুগের সকল প্রথা, উদ্ভাবন ও কুফরি কার্যকলাপ যা আজ আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে তা রহিত করা এবং এই সত্য ধর্মকে সারা বিশ্বে প্রচার করা। যেমনটি ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ে। আবারও নববি যুগের স্মৃতি তাজা করা হোক।

Exit mobile version